বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তিতে রড উৎপাদনে অগ্রগামী জিপিএইচ ইস্পাত

অনলাইন ডেক্স: আমদানি করা পুরোনো লোহার টুকরা বা স্ক্র্যাপ প্রথমে চুল্লির ওপর প্রি-হিটিং চেম্বারে রাখা হয়। চুল্লির ভেতরে স্ক্র্যাপ গলানো হয় ১,৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। গলানোর সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইম, ডমোলাইট, নাইট্রোজেন, কার্বন ও অক্সিজেন যোগ করে স্ক্র্যাপ পরিশোধন করা হয়। ফলে নির্দিষ্ট সময় পর চুল্লির ওপরে অপদ্রব্য জমা হয়, আর নিচে বিশুদ্ধ তরল ইস্পাত পাওয়া যায়। চুল্লি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৪ ডিগ্রি কাত হয়ে এই অপদ্রব্য ফেলে দেয়।

এদিকে, চুল্লির ওপরের প্রি-হিটিং চেম্বারে থাকা স্ক্র্যাপ ৬০০ ডিগ্রি পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়, যা চুল্লিতে দ্রুত গলানোর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। প্রাথমিক পরিশোধনের পর ল্যাডেল রিফাইনিং ফার্নেস (এলআরএফ)-এ ডি-সালফারাইজেশন সম্পন্ন হয় এবং প্রয়োজনীয় উপাদান যোগ করা হয় নির্দিষ্ট গ্রেড অনুযায়ী। এরপর কন্টিনিয়াস কাস্টিং মেশিন (সিসিএম)-এর মাধ্যমে বিলেট উৎপাদন করা হয়, যা স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় কারখানার ভেতর দিয়ে গড়িয়ে রডে রূপান্তরিত হয়।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অবস্থিত জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় বিশ্বের সর্বাধুনিক কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (Quantum Electric Arc Furnace) প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই রড উৎপাদন করা হয়। এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বে দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০২০ সালে বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি নিয়ে আসে জিপিএইচ ইস্পাত। বর্তমানে তারা ৬০০ গ্রেডের উচ্চশক্তির রড জিপিএইচ কোয়ান্টাম ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করছে।

এই উচ্চশক্তির রড পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়েছে।

গত ২৯ জানুয়ারি জিপিএইচ ইস্পাত কারখানার উৎপাদনপ্রক্রিয়া সরেজমিনে পরিদর্শন করান প্রতিষ্ঠানটির হেড অব কোয়ালিটি কন্ট্রোল, প্রকৌশলী মশিউর রহমান ভূঁইয়া। তিনি জানান, কারখানার কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি সর্বোচ্চ বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে বিলেট উৎপাদন করে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, পানি ও বায়ু পরিশোধনসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করে কারখানাটিকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে জিপিএইচ ইস্পাতই প্রথম ৬০০ গ্রেডের উচ্চশক্তির রড উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। এই রডের লোডিং ক্ষমতা বেশি হওয়ায়, ৫০০ গ্রেডের তুলনায় সর্বোচ্চ ২০% এবং ৪২০ গ্রেডের তুলনায় সর্বোচ্চ ৩০% রড সাশ্রয় করা সম্ভব। ফলে নির্মাণ কাজে কম রড ব্যবহারের ফলে কলামের সেকশন সাইজ কমানো যায়, যা ভবনের নকশায় অতিরিক্ত জায়গা তৈরি করে এবং সামগ্রিক নির্মাণ খরচ কমায়।

জিপিএইচ ইস্পাতের অত্যাধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি বাংলাদেশের নির্মাণশিল্পে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। উচ্চশক্তির ৬০০ গ্রেডের রড ব্যবহারের ফলে শুধু নির্মাণ খরচই সাশ্রয় হচ্ছে না, বরং স্থাপনার স্থায়িত্বও নিশ্চিত হচ্ছে। এই প্রযুক্তি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১৫০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা বর্তমানে ১০ লাখ টন। প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদিত ইস্পাত দেশের পাশাপাশি চীনেও রপ্তানি করেছে।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) অনুযায়ী, দেশে ইস্পাত খাতে প্রায় ৪০টি স্বয়ংক্রিয় কারখানা রয়েছে, যার মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান মাত্র ৪-৫টি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে ১ কোটি টনের বেশি রড উৎপাদন করতে সক্ষম। অন্যদিকে, বাংলাদেশে বার্ষিক রডের চাহিদা ৬৫-৭৫ লাখ টন।

জিপিএইচ ইস্পাতের মেল্টিং সেকশনে আধুনিক কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে স্ক্র্যাপ ইস্পাতকে উচ্চতাপে গলিয়ে বিশুদ্ধ রড উৎপাদন করা হয়।

রেললাইনের ওপর রেলগাড়ির মতো একটার পর একটা বিলেট কন্টিনিয়াস কাস্টিং মেশিন (সিসিএম)-এর মাধ্যমে গঠিত হচ্ছে। উৎপাদিত বিলেট সরাসরি রোলিং মিলে পাঠানো হয়, যেখানে রি-হিটিং ফার্নেসের মাধ্যমে উত্তপ্ত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোলিং মেশিনে রোল করা হয়। একাধিক ধাপে গড়ানোর পর নির্দিষ্ট আকৃতির রড তৈরি হয়ে কুলিং বেডে ঠান্ডা হয় ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঁধাই করা হয়। পরে বিশাল চুম্বকযুক্ত ক্রেনের সাহায্যে রড ট্রাকে তোলা হয়।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে কার্বন নিঃসরণ খুবই কম। ফলে কারখানার পরিবেশে কোনো অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি হয় না।

রড উৎপাদনে প্রচুর পানি ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। সীতাকুণ্ডে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে থাকায়, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে জিপিএইচ ইস্পাত পাহাড়ি এলাকায় ১৫ লাখ ঘনমিটার ধারণক্ষম বিশাল একটি ড্যাম তৈরি করেছে। এখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে উৎপাদন কাজে ব্যবহার করা হয়।

এ ছাড়া, উৎপাদন থেকে নির্গত পানি পরিশোধন করে পুনরায় ব্যবহার করা হয়, যার ফলে ৯০% পানি পুনরায় কাজে লাগানো সম্ভব হয়।

বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য জিপিএইচ ইস্পাতের ঘণ্টায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন। এর মধ্যে ১২ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। পাশাপাশি, জিপিএইচ রিনিউবল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ৬ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা কোম্পানি কিনে নেয়।

জিপিএইচ ইস্পাত সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্বন ক্রেডিট চুক্তি করেছে, যার মাধ্যমে তারা মাসে ২০ লাখ ডলার আয় করছে। এই চুক্তির মেয়াদ চার বছর।

জিপিএইচ ইস্পাত রড উৎপাদন সক্ষমতা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৮ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার প্রয়োজন। এর মধ্যে ১৫ কোটি ডলার হংকং স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে, আর বাকি অর্থ কোম্পানির পুঞ্জীভূত মুনাফা (Retained Earnings) থেকে জোগান দেওয়া হবে।

জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন,আমরা নতুন কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা কত হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত করিনি। অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ার পরই বিস্তারিত পরিকল্পনা করব।”

তিনি আরও বলেন,উচ্চশক্তির ৬০০ গ্রেডের রড ব্যবহারের ফলে পরিমাণগতভাবে রডের ব্যবহার কমানো সম্ভব। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মতো প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। এতে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।

জিপিএইচ ইস্পাতের অত্যাধুনিক কোয়ান্টাম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি বাংলাদেশকে ইস্পাত উৎপাদনে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। উচ্চশক্তির রড ব্যবহারের ফলে নির্মাণ খরচ কমানো সম্ভব হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।