নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে চাহিদা বৃদ্ধি নাকি বাজার কারসাজি?

অনলাইন ডেক্স: বাংলাদেশে রমজান এলেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা যায়, যা কখনো কখনো এতটাই তীব্র হয় যে তা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। চলতি বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মোটা চাল, সয়াবিন তেল, আলু, ছোলা, খেজুর ও ডিমসহ বেশিরভাগ পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

রমজান শুরুর সপ্তাহখানেক আগে থেকেই বাজারে ভিড় বাড়ে, আর তখনই ক্রেতাদের বাড়তি দামের চাপ সামলাতে হয়। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাবাসীকে মোটা চাল, ভোজ্যতেল, ছোলা, খেজুর ও ডিম গত বছরের তুলনায় বেশি দামে কিনতে হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এ পরিস্থিতি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে দুটি মূল কারণ রয়েছে—প্রাকৃতিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং বাজার কারসাজি।

রমজানে ভোজ্যতেল, ছোলা, চিনি, খেজুর ও ডিমের চাহিদা অনেক গুণ বেড়ে যায়, যা স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়ায়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার নিয়ন্ত্রণ, মজুতদারি, এবং সরকারের দুর্বল তদারকির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে দাম বাড়ছে। সরকার তদারকি জোরদার করলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।’

ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি বিক্রেতা আবুল হাশেম জানান, মাত্র চার-পাঁচটি বড় প্রতিষ্ঠান চিনি ও ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। যখন তারা আমদানি কমিয়ে দেয়, তখন সরবরাহে সংকট দেখা দেয় এবং দাম বেড়ে যায়।

ছোট পোল্ট্রি খামারি ও সরবরাহকারীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার জানান, ২০২৩ সালে সরকারের অভিযান চালানোর পর রাতারাতি ব্রয়লার মুরগির দাম কমে যায়। এটি প্রমাণ করে যে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়।

সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নিলেও তা দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হয়নি। অভিযানের মাধ্যমে সাময়িকভাবে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনা গেলেও বাজার পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান হয়নি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাসের হোসাইন বলেন, ‘বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি মনিটরিং না থাকায় ব্যবসায়ীরা একই পদ্ধতিতে বারবার কারসাজি করতে পারেন।’

সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ উদ্যোগ সম্পর্কে মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। একই সময়ে যখন লাখ লাখ মানুষ একই পণ্য কিনতে যান, তখন সরবরাহ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।’

বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘমেয়াদি বাজার তদারকি এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছেন। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘সরবরাহ-চাহিদার তথ্য ডিজিটালভাবে ট্র্যাক করতে হবে, যাতে সরকার আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে পারে।’

প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে রোজায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রবণতা নতুন নয়। তবে অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতির কারণে এবারের মূল্যবৃদ্ধি কম আয়ের মানুষের জন্য বাড়তি সংকট তৈরি করেছে।

সরকার যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি জোরদার না করে, তবে সামনের বছরও একই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে। আপাতত, ক্রেতাদের জন্য খরচে কাটছাঁট করা ছাড়া বিকল্প খুব একটা নেই।