ইস্পাহানি পরিবারের ব্যবসায়িক ঐতিহ্য, দুই শতকের সফল পথচলা

অনলাইন ডেক্স: ইরানের ইসফাহান থেকে যাত্রা শুরু করে ভারতের বিভিন্ন শহর হয়ে ইস্পাহানি পরিবার চট্টগ্রামে ব্যবসার মূল কেন্দ্র স্থাপন করে। দেশভাগের আগে, ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত, তাদের ব্যবসা সমানতালে কলকাতা ও চট্টগ্রামে চলছিল। তবে ১৯৬৫ সালে ভারত সরকার ইস্পাহানি পরিবারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে, তাদের ব্যবসা পুরোপুরি বাংলাদেশে কেন্দ্রীভূত হয়।

ইস্পাহানি পরিবারের ব্যবসা শুরু হয় ১৮২০ সালে। সময়ের পরিক্রমায় এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।

১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যের মার্কেন্টাইল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া লিমিটেড পূর্ব বাংলায় সম্ভাব্য ব্যবসায়িক পরিবেশ মূল্যায়নের জন্য লিওনেল ব্ল্যাঙ্কস নামের এক কর্মকর্তাকে পাঠায়। তিনি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম সফর শেষে তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন—

ইস্পাহানি পরিবার চট্টগ্রামে বড় পরিসরে ব্যবসা সম্প্রসারণে যাচ্ছে।তারা আসকারদীঘির পাড়ে ‘বিশপ হাউস’ কিনেছে এবং শহরের বিভিন্ন জায়গায় জমি অধিগ্রহণ করছে।

এই পর্যায় থেকেই ইস্পাহানি পরিবারের ব্যবসায়িক সাফল্যের ভিত শক্তিশালী হতে শুরু করে। লিওনেল ব্ল্যাঙ্কসও অনুমান করেছিলেন, চট্টগ্রামের বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা প্রসারের ফলে এ অঞ্চল একসময়ের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠবে।

দেশভাগের পর ইস্পাহানি পরিবার কলকাতা থেকে তাদের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে। ২০২৪ সালে ইস্পাহানি গ্রুপ চট্টগ্রামে ব্যবসার ৭৫ বছর (প্লাটিনাম জয়ন্তী) পূর্ণ করছে।

বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬০টি দেশে ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে শুধু ইস্পাহানি পরিবারই এই তালিকায় স্থান পেয়েছে।

গত ৩০ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ইস্পাহানি ভবনে পরিবারের সপ্তম প্রজন্মের উত্তরসূরি মির্জা সালমান ইস্পাহানি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। দীর্ঘ পথচলার নানা গল্প ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন।

ইস্পাহানি পরিবারের ব্যবসায়িক সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস ও বাণিজ্যিক ঐতিহ্য। সময়ের পরিক্রমায়, এটি শুধু একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং দেশের শিল্প ও বাণিজ্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

ইসফাহান থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্পাহানি পরিবারের বাণিজ্যিক ঐতিহ্য

পারস্য (বর্তমান ইরান) থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে বণিকদের আগমন বহু পুরোনো। সেই ধারাবাহিকতায় ১৮২০ সালে ইরানের ইসফাহান শহর থেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মুম্বাইতে আসেন হাজি মোহাম্মদ হাশিম। তাঁর হাত ধরেই ইস্পাহানি পরিবারের ২০২ বছরের ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু হয়।

সময়ের সঙ্গে মোহাম্মদ হাশিম ও তাঁর উত্তরসূরিরা লন্ডন, মিসর, রেঙ্গুন, চেন্নাই, কলকাতা, ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন।

দেশভাগের আগে চা ও পাটের ব্যবসার পাশাপাশি ইস্পাহানি গ্রুপ বিমান পরিবহন, ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স খাতেও বিনিয়োগ করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের বছরে, কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি (এম এ ইস্পাহানি)।

পরবর্তীতে ইস্পাহানি পরিবারের অনেকে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত ও পাকিস্তানে ব্যবসা বিস্তৃত করেন। তবে কলকাতা থেকে আসা উত্তরসূরিরা বাংলাদেশের ইস্পাহানি গ্রুপের কার্যক্রম সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখেন।

বাংলাদেশে ইস্পাহানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানির দাদা এম এ ইস্পাহানি। তাঁর হাত ধরে চট্টগ্রামে একের পর এক শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে।

দেশভাগের পর কলকাতার ভিক্টোরি জুট মিলের যন্ত্রপাতি খুলে এনে চট্টগ্রামের কাট্টলীতে একই নামে পাটকল স্থাপন করা হয়।১৯৫০ সালে কালুরঘাটে চিটাগাং জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯৫৪ সালে পাহাড়তলীতে পাহাড়তলী টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারি মিল নামে বস্ত্রকল গড়ে তোলে ইস্পাহানি গ্রুপ।

ইস্পাহানি শুধু শিল্পকারখানা স্থাপনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে—

  • ইস্টার্ন ফেডারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান শেয়ারহোল্ডার হিসেবে কোম্পানির সদর দপ্তর কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করেন এম এ ইস্পাহানি।
  • বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিপিং ব্যবসায়ও যুক্ত হয় গ্রুপটি।
  • ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে পাটকল স্থাপনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকটি পরিবারের মধ্যে ইস্পাহানি অন্যতম ছিল— যা রুশ অর্থনীতিবিদ এস এস বারানভ তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেন।

ইস্পাহানি গ্রুপের হাত ধরে দেশের শেয়ারবাজারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান— ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)— প্রতিষ্ঠার পেছনেও ভূমিকা রয়েছে।

দুই শতকেরও বেশি সময় ধরে ইস্পাহানি পরিবার শুধু ব্যবসায়িক সফলতার গল্প লেখেনি, বরং এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার অন্যতম পথিকৃৎ হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রামে ব্যবসার ভিত্তি গড়ে তোলার পর থেকে শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে ইস্পাহানি পরিবারের অবদান আজও সুদৃঢ়।

 বিপণন থেকে চায়ের উৎপাদন ইস্পাহানির নতুন অধ্যায়

শুরুতে ইস্পাহানি গ্রুপের প্রধান ব্যবসা ছিল চায়ের বিপণন ও রপ্তানি। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চা সরবরাহ করত তারা। তবে চট্টগ্রামে আসার পর শুধু বিপণন নয়, চায়ের উৎপাদনেও যুক্ত হয় ইস্পাহানি গ্রুপ।

  • ১৯৬০ সালে, চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে নেপচুন চা-বাগানের খাসজমিতে চা উৎপাদন শুরু করে ইস্পাহানি।
  • পর্যায়ক্রমে মৌলভীবাজারের জেরিন চা-বাগান, গাজীপুর চা-বাগান এবং মির্জাপুর চা-বাগান ইস্পাহানির অধীনে আসে।
  • ২০০৫ সালে, ফিন্‌লের চা-বাগানের শেয়ার কিনে ইস্পাহানি চা-ব্যবসার পরিধি আরও সম্প্রসারিত করে।

বর্তমানে ইস্পাহানির চারটি চা-বাগানের মোট আয়তন ৭,৮৮৫ একর।

  • ২০২০ সালে, ইস্পাহানি গ্রুপের চা-বাগানগুলো থেকে ৪৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়।
  • উৎপাদনের দিক থেকে এটি দেশের চতুর্থ বৃহত্তম কোম্পানি।
  • একরপ্রতি উৎপাদনের ক্ষেত্রেও শীর্ষ তিনটি চা-বাগানের মধ্যে একটি ইস্পাহানি।
  • ২০২৩ সালে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় পরিবেশবান্ধব কারখানার পুরস্কার চালু করলে প্রথমবারের মতো সেরা পরিবেশবান্ধব চা-বাগান হিসেবে নির্বাচিত চারটির মধ্যে দুটি ছিল ইস্পাহানির।

ব্যাংক, বিমা ও এয়ারলাইনস পথিকৃৎ ইস্পাহানি

শিল্প ও বাণিজ্যের পাশাপাশি ব্যাংকিং, বিমা ও বিমান পরিবহন খাতেও পথ দেখিয়েছে ইস্পাহানি গ্রুপ।১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর, কলকাতায় ‘ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করে ইস্পাহানি গ্রুপ। এটি ছিল পূর্ব বাংলার প্রথম বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থা।যদিও ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে পাকিস্তান সরকার এটি অধিগ্রহণ করে।

ব্যাংক ও বিমা খাতেও ইস্পাহানির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে

  • কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি।
  • দেশভাগের আগে ইস্টার্ন ফেডারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রধান শেয়ারহোল্ডারও ছিলেন তিনি।

ইস্পাহানি গ্রুপ বেসরকারি উড়োজাহাজ ব্যবসার অগ্রদূত হলেও পরবর্তী সময়ে এই খাতে আর ফিরে আসেনি।

এ প্রসঙ্গে ইস্পাহানি গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানি বলেন—
আমার দাদার (এম এ ইস্পাহানি) হাতে এই ব্যবসার সূচনা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৬ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর আমাদের পরিবারের আর কেউ এই খাতে অভিজ্ঞ ছিল না। তাই বিমান পরিবহন ব্যবসায় আর ফেরা হয়নি।’

শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, চা শিল্প—সব ক্ষেত্রেই ইস্পাহানি গ্রুপ একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্যবসার শুরুতে বিপণনের দিকে গুরুত্ব দিলেও পরবর্তীতে উৎপাদন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সফলভাবে নিজেদের প্রসারিত করেছে।

 বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ইস্পাহানি গ্রুপের আধুনিক উদ্যোগ

ইস্পাহানি গ্রুপ পুরোনো ব্যবসা ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। তাদের ব্যবসার পরিধি এখন চা বিপণন ও উৎপাদন, টেক্সটাইল, আবাসন, খাদ্যপণ্য, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, কনটেইনার ডিপো, প্যাকেজিং, জুট বেলিং, সিকিউরিটিজ এবং পর্যটন সহ ১৮টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিস্তৃত।

গ্রুপটির ব্যবসায়িক নীতি কখনোই আগ্রাসী বিনিয়োগের দিকে যায়নি, বরং ধীর ও পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ করেছে।

বিনিয়োগে নতুন দিগন্ত

ঢাকার মগবাজারে ইস্পাহানি কলোনি-তে একটি ৪৫৭ অ্যাপার্টমেন্টের কনডোমিনিয়াম প্রকল্প যৌথভাবে গড়ে তুলছে গ্রুপটি।দুই দশক আগে খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পর এখন নতুন উদ্যোগ নিতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করছে গ্রুপটি।

পাটকলের পাশাপাশি টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে ইস্পাহানি। ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে ‘পাহাড়তলী টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারি মিলস’ কারখানা সম্প্রসারণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বার্ষিক লেনদেন ৬০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

২০১৮ সালে চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলীতে ভিক্টোরি জুট মিল-এর জায়গায় কনটেইনার ডিপো গড়ে তুলেছে ইস্পাহানি, সামিট গ্রুপ ও অ্যালায়েন্স হোল্ডিংস লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে।

গাজীপুরে চায়ের অত্যাধুনিক কারখানা গড়ার পরিকল্পনা ১৩০ কোটি টাকায় চলছে।ঢাকা ও খুলনায় পর্যটন ব্যবসায় বিনিয়োগের পরিকল্পনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

ইস্পাহানি গ্রুপ ১২ হাজার কর্মী নিয়োগ করেছে এবং তাদের পরিবারকেও একটি পরিবারের অংশ হিসেবে মনে করে। গ্রুপটি কর্মীদের সুবিধা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে:

  • শিক্ষা বিনা খরচে শ্রমিক ও মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সন্তানদের পড়ালেখার ব্যবস্থা।
  • চিকিৎসা কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা।
  • মুনাফায় অংশগ্রহণ কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে ইস্পাহানি।
  • করোনা মহামারির সময়ে করোনার সময়েও কর্মীদের পদোন্নতি বা সুযোগ-সুবিধা কিছুই কাটছাঁট হয়নি এবং চাকরি হারায়নি কেউ।

ইস্পাহানি গ্রুপ নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা বিস্তার করছে এবং একইসাথে কর্মসংস্থান ও শ্রমিক কল্যাণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাদের পরিকল্পিত ব্যবসা নীতি ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন চেষ্টার ফলস্বরূপ তারা আজ এক একটি শক্তিশালী শিল্প গ্রুপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

 ইস্পাহানির চোখে আগামীর বাংলাদেশ

সম্প্রতি জার্মানির রাষ্ট্রদূত চট্টগ্রামে ইস্পাহানি গ্রুপের টেক্সটাইল কারখানা পরিদর্শন করেন। কারখানা পরিদর্শন শেষে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “মনে হচ্ছে ইউরোপের কোনো কারখানায় এসেছি।”

এ মন্তব্যে যে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ব্যবহারে ইস্পাহানি গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় অবস্থান উঠে এসেছে, তা স্পষ্ট। গ্রুপের বর্তমান চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানি প্রথম আলোকে বলেন, “যদি ইউরোপে কোনো নতুন যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী হয়, তাহলে তা এই দেশে প্রথম ক্রেতা পায় আমাদের উদ্যোক্তারা।” তাঁর মতে, দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাহসিকতা এবং প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত।

তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি আশাবাদ

মির্জা সালমান ইস্পাহানি দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি বেশ আশাবাদী। তাঁর মতে, বর্তমান তরুণরা অত্যন্ত দক্ষ এবং বিদেশি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় তারা ভালো পারদর্শিতা দেখাচ্ছে। এসব তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে তিনি ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত আশাবাদী।

তবে সাফল্যের জন্য তরুণদের প্রতি মির্জা সালমান ইস্পাহানির পরামর্শ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক: “কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। সাফল্য পেতে হলে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করতে হবে এবং কোনো কিছু গভীরভাবে আয়ত্ত করলে সাফল্য আসবেই।”

ইস্পাহানি গ্রুপের যথাযথ উদ্যোগ, আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ এবং তরুণদের প্রতি বিশ্বাস আগামীর বাংলাদেশে নতুন সম্ভাবনা এবং উদ্ভাবনের সূচনা করবে, এমনটাই মনে করেন তিনি।

 ইস্পাহানি পরিবারের দূরদর্শিতা এবং বাংলাদেশের অগ্রগতি

বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি’র অধিগ্রহণে আসা মার্কেন্টাইল ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা লিওনেল ব্ল্যাঙ্কস ১৯৪৭ সালে দেওয়া এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন যে, দেশভাগের পর অস্থির সময়ে চট্টগ্রামে হংকং ব্যাংকের শাখা খোলা ছিল উপযুক্ত সময় নয়। তবে, তিনি এইও জানান যে, ইস্পাহানি পরিবার তখনই পরামর্শ দিয়েছিল হংকং ব্যাংক নতুন শাখা খুলতে। ইস্পাহানি পরিবারের সেই দূরদর্শী মতামত ছিল সঠিক, যা তাদের অগ্রগতির মাধ্যমে এবং চট্টগ্রামকে ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, যখন বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সব কারখানা জাতীয়করণ করা হয়, তখন ইস্পাহানি পরিবারের চা-বাগান ও কারখানাও সরকারের অধীনে চলে যায়। তবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’র সরকার খুব বেশি সময় নেয়নি সেগুলি পুনরুদ্ধারে। একমাত্র চিঠি দিয়েই মির্জা সালমান ইস্পাহানির দাদাকে বাগান-কারখানা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। এর পর থেকেই ইস্পাহানি গ্রুপ এ দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং ক্রীড়া খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

৭৫ বছর আগে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশকে প্রধান কার্যালয় হিসেবে বেছে নিয়ে ইস্পাহানি গ্রুপ শুধু এই দেশেই ব্যবসা বিস্তার করেনি, বরং সততা এবং নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ব্যবসা পরিচালনার উদাহরণও স্থাপন করেছে। তারা বাংলাদেশি ব্র্যান্ডকে বিশ্বে পরিচিত করেছে এবং ২০২ বছরের পারিবারিক ব্যবসা শুধুমাত্র ইস্পাহানি পরিবারের নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও গৌরবের।

ইস্পাহানি গ্রুপের দীর্ঘ ইতিহাস এবং তার অগ্রগতি দেশের অর্থনীতি, শিল্প এবং বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।