
প্রতিবেদক:ঢাকার যানজটে অনেক সময় ছোট ছোট অলি গলিতে গেম খেলি, তার মধ্যে একটি প্রিয় গেম হলো রাস্তায় নকল কেএফসি আউটলেট গোনা। কেএফসি’র এসব স্বঘোষিত উত্তরসূরির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে এবং তা স্থানীয়দের কাছে এক ধরনের মজার অভ্যন্তরীণ কৌতুকের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, এটি আমাদের দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোর ক্ষেত্রেও এক প্রবণতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যেখানে নাম এবং ধারণা নিয়ে অনেক নকল সংস্করণ তৈরি হচ্ছে।
একটি উদাহরণ হিসেবে, হাজি বিরিয়ানি-এর নাম দখল করে একাধিক নকল ব্র্যান্ড গজিয়ে উঠছে। নামের আগে-পিছে নানা উপসর্গ যোগ করে নতুন নতুন সংস্করণ তৈরি হচ্ছে, যেমন ‘অরিজিনাল হাজি বিরিয়ানি’, ‘ক্যাফে হাজি বিরিয়ানি’ বা ‘পুরান ঢাকা হাজি বিরিয়ানি’। এই ধরনের ব্র্যান্ডগুলি দাবি করতে পারে যে তারা আসল হাজি বিরিয়ানির শাখা, কিন্তু গ্রাহকদের বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। এই প্রবণতা অনুপ্রেরণা এবং প্রতারণার মধ্যে সূক্ষ্ম সীমারেখা তৈরি করছে, যা ভবিষ্যতে আইনি জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
এটি শুধু হাজি বিরিয়ানি নয়, অন্য অনেক ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ওয়াফেল আপ আমাদের স্থানীয় বাজারে ওয়াফেল-অন-এ-স্টিক ধারণা প্রথম নিয়ে আসে। তাদের সাফল্যের পর, আরও অনেক ব্র্যান্ড ওয়াফেল টাইম এবং ওয়াফেল বাই এর মতো একই ধারণা নিয়ে মাঠে নেমেছে, যদিও তাদের মেন্যু প্রায় একই, শুধু নামের মধ্যে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। “আসল ওয়াফেল আপ চিনুন” বা “অরিজিনাল ওয়াফেল আপকে জানুন” এর মতো স্লোগান ব্যবহারের মাধ্যমে তারা নকল সংস্করণের থেকে নিজেদের আলাদা করতে চাচ্ছে।
এছাড়া, ‘বার বি কিউ টোনাইট’ রেস্তোরাঁও একই সমস্যার সম্মুখীন। গুগলে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, একাধিক বিকল্পের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে, যেমন ‘বার বি কিউ টুনাইট’ এবং ‘বার বি কিউ টোনাইট (অরিজিনাল)’। এতে গ্রাহকদের জন্য কোনটি আসল তা বুঝতে কঠিন হয়ে পড়ছে এবং অনেক সময় তারা ভুলভাবে নকল ব্র্যান্ডের দিকেও চলে যেতে পারে।
এ ধরনের নকল ব্র্যান্ডগুলি অস্বীকৃত অনুপ্রেরণা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোর পরিচিতির কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে। তাদের লক্ষ্য হলো, আসল ব্র্যান্ডের মতো দেখতে এবং একই ফন্ট ব্যবহার করে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করা। এর ফলে, নকল ব্র্যান্ডগুলোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা আসল ব্র্যান্ডের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়।
এই ধরনের নকল ব্র্যান্ডগুলি আইনি ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে মূল ব্র্যান্ডগুলোর ইমেজের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যদি এটি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তবে ভবিষ্যতে অনুপ্রেরণা এবং প্রতারণার মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে ব্র্যান্ড ইমেজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ‘খানাস’ এবং ‘কুডোস’-এর মতো ব্র্যান্ডগুলো প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে। ‘কুডোস’ ‘খানাস’-এর মতো একই মেনু অনুসরণ করে না, তবে তাদের লোগোতে একে অপরের কাছাকাছি একই রঙের প্যালেট ব্যবহার করে।
এছাড়া, ‘খানাস’-এর ট্যাগলাইন হলো ‘কম খান’, আর ‘কুডোস ‘ ভাল খাও’ -এর ট্যাগলাইনও অনেকটা একরকম।
ব্র্যান্ড ইমেজের ক্ষতি
ফেসবুকে একটি জনপ্রিয় ফুড গ্রুপে একজন ব্যবহারকারী এওয়েক ক্যাফে অ্যান্ড বিস্ট্রোতে তার নেতিবাচক অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলেন, তবে ভুলবশত তিনি ‘এওয়েক কফি রোস্টার’ পেইজে ট্যাগ করে ফেলেন। এরপর তিনি বিভ্রান্তি পরিষ্কার করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এই ধরনের পরিস্থিতি মূল ব্র্যান্ডের ইমেজের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে, বিশেষ করে যখন রেপ্লিকা ব্র্যান্ডগুলো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
এওয়েক কফি রোস্টার-এর প্রথম শাখাটি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় খোলা হয়েছিল, তবে জমির মালিকের সঙ্গে বিবাদের কারণে এটি বনানীতে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে শীঘ্রই একটি অনুরূপ ক্যাফে খোলা হয়, যা গ্রাহকদের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। প্রতিষ্ঠাতা নাভিদ হাসান জানান, “বসুন্ধরাতে নতুন খোলা এওয়েক ক্যাফে অ্যান্ড বিস্ট্রো অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। তারা আমাদের পুরানো স্টোরের মতো ডিজাইন রেখে সামান্য পরিবর্তন করে ক্যাফেটি আবার চালু করেছে। একই চেহারা ও নামের কারণে গ্রাহকদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।”
রেপ্লিকা ব্র্যান্ডের বিপদ
এ ধরনের রেপ্লিকা ব্র্যান্ডগুলোর কারণে মূল ব্র্যান্ডের বাজারে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। হাজি বিরিয়ানি-এর মালিক হাজি শাহেদ হোসেন বলেন, “আমাদের গ্রাহকরা জানেন যে আমরা কখনও ছদ্মবেশী ব্র্যান্ডের সঙ্গে মিশে যাই না। সবাই জানে আমরা পুরান ঢাকায় আছি এবং আমরা এখানে বহুদিন ধরে রয়েছি।” তবে, অনলাইন ল্যান্ডস্কেপে পরিস্থিতি বদলে যায়, কারণ হাজি বিরিয়ানি-এর সোশ্যাল মিডিয়া পেজ খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, কারণ একই নামের অনেক পেজ রয়েছে।
অতীতে হাজি বিরিয়ানি তাদের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে রেপ্লিকা ব্র্যান্ডগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চেষ্টা করেছে, তবে এ ধরনের বিভ্রান্তি প্রতিরোধ করা খুবই কঠিন।
আইন কি ব্র্যান্ড রক্ষা করতে পারে?
কোম্পানিগুলোকে রক্ষা করার জন্য ট্রেডমার্ক আইন রয়েছে, তবে নকল ব্র্যান্ডগুলো কেন টিকে থাকে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। ফারুক অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস-এর জুনিয়র পার্টনার মো. আশিকুর রহমান বলেন, “ব্র্যান্ডের আইনগত সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও, প্রতিলিপি ব্র্যান্ডগুলো বিভিন্ন কারণে এখনও বিদ্যমান থাকে। উদাহরণস্বরূপ, তারা সরাসরি আইনি লঙ্ঘন এড়াতে আসল লোগো বা নাম পরিবর্তন করে, যা তাদের তাৎক্ষণিক আইনি ঝামেলার সম্মুখীন না হওয়ার সুযোগ দেয়।” তিনি আরও বলেন, “মেধাসম্পদ আইনের প্রয়োগ অনেক সময় ধীর এবং দুর্বল হয়ে পড়ে, যা আইনি পদক্ষেপ নিতে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় করে।”
আইনি সমস্যা
অনেক স্থানীয় ব্র্যান্ড এই আইনি ত্রুটির শিকার। নাভিদ হাসান জানান, “আমাদের প্রাথমিক চুক্তিতে উল্লেখ ছিল যে জমির মালিক ‘এওয়েক কফি রোস্টার্স’ নামে কোনো ক্যাফে চালাতে পারবেন না, তবে তারা নামটি কিছুটা পরিবর্তন করেছে, ফলে একটি ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের আইনি দল বলছে, আইনি পদক্ষেপ নিলেও তা কার্যকর করতে অনেক সময় লাগবে, কারণ বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক আইন কার্যকরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না।”
এছাড়া, ট্রেডমার্ক আইন ২০০৯-এর ধারা ২৪ অনুযায়ী, যদি ব্র্যান্ডটি ট্রেডমার্ক না করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। আশিকুর রহমান সুপারিশ করেন, ব্র্যান্ডগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের ট্রেডমার্ক করুক এবং নকল ব্র্যান্ডগুলোর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করুক।
নকল ব্র্যান্ডগুলোর কারণে মূল ব্র্যান্ডের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আইনি পদক্ষেপ নিলে সেই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হলেও বাংলাদেশে ট্রেডমার্ক আইন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ধীর এবং দুর্বল। তাই, ব্র্যান্ডগুলোকে তাদের নাম এবং লোগো ট্রেডমার্ক করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।