
প্রতিবেদক: সরকারি মালিকানাধীন একটি দোকান থেকে মাসে তিন লাখ টাকা ভাড়া নেওয়া হলেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়ছে মাত্র ২২ হাজার টাকা। এ ধরনের অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) পরিচালিত নয়টি মার্কেট নিয়ে করা সাম্প্রতিক ডেইলি স্টার পত্রিকার এক তদন্তে। এসব মার্কেটের দোকান বরাদ্দ ও ভাড়া সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার প্রমাণ মিলেছে।
২০২৩ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গঠিত তদন্ত কমিটি এই অনিয়মগুলোর খোঁজ পায় এবং সরকারের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে কাজ শুরু করে। কমিটি যেসব অনিয়ম চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে রয়েছে নিয়মবহির্ভূত দোকান বরাদ্দ, একাধিকবার ইজারা হস্তান্তর, জরুরি পরিষেবার অপব্যবহার, অবৈধ দখল এবং আর্থিক নথিতে গরমিল।
কমিটি তাদের ১৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন ২০২৩ সালের নভেম্বরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দেয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এনএসসির কর্মকর্তারা এসব অনিয়মের দায় এড়াতে পারেন না। বরং কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্টেডিয়াম প্রশাসন ও দোকান মালিকদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, যারা বরাদ্দ ও ভাড়া আদায়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত।
দুর্নীতির এ চিত্র দেখে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সংশ্লিষ্ট অপরাধ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হস্তক্ষেপ চেয়েছে। উল্লেখ্য, ঢাকার মধ্যে অবস্থিত এই নয়টি মার্কেটে এক হাজার ৭৫টি দোকান রয়েছে, যেগুলোর বড় অংশই নানা অনিয়মের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের একটি ৮১২ বর্গফুট দোকানের ইজারাদার শামসুর রহমান গং সরকারকে প্রতি মাসে দেন মাত্র ২১ হাজার ৯৩৪ টাকা। অথচ চতুর্থ পক্ষকে তিনি একই দোকান তিন লাখ টাকায় ভাড়া দিয়েছেন। এনএসসি এই বাড়তি ১৩ গুণ ভাড়ার কোনো অংশই পায় না। একইভাবে, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের ১৫৬ বর্গফুট দোকানটির মূল ইজারাদার সরকারকে দেন ৪ হাজার ৩৫৭ টাকা, কিন্তু বর্তমানে দোকানটি যিনি চালান, তিনি মাসে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া দেন।
এই ধরনের অনিয়ম শুধুমাত্র একটি বা দুটি মার্কেটে সীমাবদ্ধ নয়। তালিকায় রয়েছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংলগ্ন সুপার মার্কেট, ভলিবল স্টেডিয়াম মার্কেট, মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের বাইরের মার্কেট, কমলাপুরের মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম মার্কেট এবং সুইমিং পুল মার্কেটসহ অন্যান্য স্থান।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ২০১৩ সালে গঠিত এনএসসির দোকান বরাদ্দ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে নতুন কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। ফলে ২০১৫ সালের পর দেওয়া বরাদ্দগুলো সঠিক নিয়ম না মেনে হয়েছে। এনএসসির নীতিমালায় প্রতি তিন বছরে একবার ভাড়া পুনর্নির্ধারণের কথা থাকলেও, তা কার্যকর না হওয়ায় সরকারি আয় বাড়েনি বরং ইজারাদারদের মুনাফা বেড়েছে।
এই অনিয়মের কারণে আয় সংক্রান্ত হিসাবেও নানা প্রশ্ন উঠেছে। ফলে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নেও তৈরি হয়েছে গভীর উদ্বেগ।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) বিভিন্ন মার্কেটের দোকান বরাদ্দ, ভাড়া আদায় এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে সম্প্রতি জমা দেওয়া এক তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, দোকান বরাদ্দে পে অর্ডার, আয়-ব্যয় বিবৃতি ও মার্কেট-সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্টের স্থিতির মধ্যে গরমিল রয়েছে। এর পাশাপাশি, নতুন বা খালি দোকান বরাদ্দে টেন্ডার প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক হলেও শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের ৩১টি দোকানে অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে নিয়ম বহির্ভূতভাবে।
প্রতিবেদনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অনিয়ম হিসেবে উঠে এসেছে এনএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গঠিত সমবায় সমিতির কার্যক্রম। এই সমিতি চার বা তার বেশি অংশের দোকানের মালিকানা নিয়ন্ত্রণ করছে, যা এনএসসির নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এছাড়াও, সরকারি অবকাঠামোর গুরুতর অপব্যবহারের অভিযোগও উত্থাপন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মিরপুরের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের সিঁড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে, স্টেডিয়ামের পানি ব্যবহার করে গাড়ি ধোয়া হচ্ছে, এবং অননুমোদিত ব্যক্তিদের কাছে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
কমলাপুরে এনএসসির মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের তৃতীয় তলায় এনএসসির কর্মচারীদের ১৬-১৭টি পরিবার অবৈধভাবে বসবাস করছে। একইসঙ্গে, দোকান মালিকদের সংগঠন এখানে কোনো অনুমোদন ছাড়া কার্যালয় পরিচালনা করছে এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক কার্যক্রমেও জড়িত রয়েছে।
প্রতিবেদক ১৩ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, মাওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম ও ভলিবল স্টেডিয়ামের মোট ১৩টি দোকান সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। প্রায় সব দোকানদারই জানান, তারা সরাসরি এনএসসির কাছ থেকে নয়, বরং দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ পক্ষের কাছ থেকে দোকান ভাড়া নিয়েছেন। মোবাইল স্পেস নামের দোকানের মালিক শফিকুল আলম জানান, ২০ বছর আগে তিনি দ্বিতীয় পক্ষের কাছ থেকে দোকানটি নিয়েছেন এবং বর্তমানে মাসে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া দেন। তবে মূল ইজারাদার কত টাকা এনএসসিকে দেন, সে বিষয়ে তিনি অবগত নন।
একই মার্কেটের আরেক দোকানদার রফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল বলেন, তিনি তৃতীয় পক্ষের কাছ থেকে দোকানটি নিয়েছেন এবং মাসে ৫০ হাজার টাকা ভাড়া দেন, অথচ মূল ইজারাদার সরকারকে দেন মাত্র দুই হাজার ৬০০ টাকা। নাহার এন্টারপ্রাইজ নামের দোকানের মালিক নজরুল ইসলামও অনুরূপ বক্তব্য দেন।
এই প্রক্রিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়াম দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এস এম আব্বাস বলেন, “যদি কেউ ইজারা নেওয়ার পর নিজে দোকান চালাতে না পারেন, তাহলে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করলে সমস্যাটা কোথায়? এখানে অপরাধটা কী?
তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় পাঁচটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার জন্য। এনএসসির সচিব মো. আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, তারা প্রতিবেদনে উল্লেখিত ১৩টি সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছেন। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে বরাদ্দ প্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশন, নিয়মিত অডিট এবং বিদ্যমান নীতিমালার পর্যালোচনা।
তবে সচিব স্বীকার করেন, এখনো পর্যন্ত কোনো দোকানের ইজারা বাতিল হয়নি। তিনি বলেন, যদি সুপারিশগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে আমরা বিশ্বাস করি, এনএসসির আয় বাড়বে।তিনি আরও জানান, পুরো ক্ষতির পরিমাণ যাচাই-বাছাই শেষে প্রকাশ করা হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন,এতে কেবল অনিয়মের অংশবিশেষ প্রকাশ পেয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও এনএসসি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বছরের পর বছর ধরে এই অনিয়ম চলে আসছে।তিনি মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান, যেন কেবল সামনের দৃশ্যমান ব্যক্তিদের নয়, বরং যারা নেপথ্যে থেকে বছরের পর বছর এই অনিয়মের সুবিধাভোগী হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।