
প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্রের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকারে বিশ্বের প্রায় সব দেশের পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তার এই শুল্কনীতি উল্টো ফল দিয়েছে। এতে ডলার, যা এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অর্থনৈতিক হাতিয়ার ছিল, সেটি ক্রমেই শক্তি হারাচ্ছে।
গত কয়েক মাস ধরেই ডলারের দরপতন হচ্ছে। ২০২৫ সালের ১৮ এপ্রিল বিশ্ববাজারের শেষ কর্মদিবসে ইউএস ডলার ইনডেক্সের মান দাঁড়ায় ৯৯.২৩-এ। অথচ জানুয়ারিতে এটি ছিল ১১০। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে ডলার ইনডেক্স ৯.৩১ শতাংশ কমেছে। ১১ এপ্রিলের পর সূচকটি প্রথমবারের মতো ১০০-এর নিচে নেমে যায়। (সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান)
শুধু এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই ইউরো ও পাউন্ডের সাপেক্ষে ডলারের দর কমেছে ৫ শতাংশ এবং ইয়েনের বিপরীতে ৬ শতাংশ। বিশেষ করে ২ এপ্রিল ট্রাম্প নতুন করে শুল্ক ঘোষণার পর থেকে ডলার আরও দ্রুত দুর্বল হতে থাকে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, মুদ্রাবাজার এখনও পুরোপুরি বাজারনির্ভর না হওয়ায় বিশ্ববাজারে ডলারের দরপতনের তাৎক্ষণিক প্রভাব এখানে পড়েনি। যদিও টাকার মান বর্তমানে বাজারের কাছাকাছি অবস্থানে এসেছে, তবে পুরোপুরি বাজারনির্ভর না হওয়ায় বিশ্ববাজারের পরিবর্তন এখানকার বাজারে প্রতিফলিত হচ্ছে না।
ভারতের বাজারেও ডলারের দরপতন ঘটেছে। গত সপ্তাহজুড়েই ডলারের বিপরীতে রুপির দর বেড়েছে। এর মানে হলো, ডলারের চাহিদা কমে যাচ্ছে—বিনিয়োগকারীরা ডলার কিনছেন কম এবং বিক্রি করে দিচ্ছেন। ট্রাম্পের শুল্কনীতির ফলে মার্কিন অর্থনীতির ওপর আস্থা কমছে।
এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ হলো, মার্কিন ট্রেজারি বন্ড—বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম—এর চাহিদাও কমে গেছে। ফলে সুদের হার বাড়াতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ কারণেই ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত শুল্ক স্থগিত করেছেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ডলার অনেকটা সোনার মতো—সুরক্ষিত বিনিয়োগের প্রতীক। সাধারণত বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা দিলে বিনিয়োগকারীরা ডলার বা সোনার দিকে ঝুঁকে থাকেন। কিন্তু এবার ডলার থেকে মুখ ফিরিয়েছেন অনেকেই।
ট্রাম্প আশা করেছিলেন, শুল্কের ঘোষণায় ডলারের মান কিছুটা কমে গেলেও শেয়ারবাজারে সূচক পতনের পর কর হ্রাসের মাধ্যমে সেটি সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু শুল্ক ঘোষণার পর মন্দার শঙ্কা তীব্র হয়, ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ পরিস্থিতি এই শঙ্কা আরও বাড়িয়েছে।
ডলারের ওপর আস্থা কমায় যুক্তরাষ্ট্রের বন্ডে বিনিয়োগ কমেছে, এর প্রভাবে ডলারের বিনিময় হার হ্রাস পেয়েছে। ট্রাম্পের শুল্কনীতি এখন উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই চাপ সৃষ্টি করছে।
তাছাড়া, বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেও পরিবর্তন ঘটছে। সুইফট নামের আন্তর্জাতিক অর্থ লেনদেন পদ্ধতি পুরোনো হয়ে উঠছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালিত ডিজিটাল মুদ্রা চালু হলে সুইফট ও ডলারের প্রয়োজন কমে যেতে পারে।
মার্কিন টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ জেফরি স্যাক্স সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জানান, ভবিষ্যতে প্রতিটি দেশ সরাসরি অন্য দেশের সঙ্গে তাদের নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রায় লেনদেন করতে পারবে। তাঁর মতে, ট্রাম্পের শুল্কনীতিই যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব আধিপত্য কমে যাওয়ার সূচনা করেছে। (সূত্র: এনডিটিভি)
ইতোমধ্যে চীন ইউয়ানে বাণিজ্য করার উদ্যোগ নিচ্ছে ব্রাজিলসহ অনেক দেশের সঙ্গে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ডলারে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমাতে চাচ্ছে। এখনই ডলারের বিকল্প কোনো মুদ্রা না এলেও বিশ্ব অর্থনীতির বাস্তবতায় পরিবর্তনের সম্ভাবনা অস্বীকার করা যাচ্ছে না।