
প্রতিবেদক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে উৎপাদন খাতে জড়িত কোম্পানিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মুনাফা কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছে। ব্যবসায়িক নেতারা এখন বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি দেশের মূল্যস্ফীতি ও ঋণের বাড়তি সুদের হার মোকাবিলা করে চলতি বছরটি কিভাবে কাটবে সে দিকেই মনোযোগ দিচ্ছেন। তবে এর মাঝেও অনেক ব্যবসায়ী আশাবাদ প্রকাশ করেছেন যে অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি এবং বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, সবচেয়ে খারাপ সময়টা হয়তো কেটে গেছে।
তিনি জানান, ডলারের বিপরীতে টাকার দাম স্থিতিশীল হয়েছে এবং রিজার্ভও আগের তুলনায় স্থিতিশীল অবস্থানে আছে। ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন। তার মতে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক থাকলে এবং ক্রেতাদের আস্থা ফিরলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব।
বর্তমান সংকটের পেছনে মূল্যস্ফীতিকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি। মহামারির পর থেকে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক চাপে তা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পায়। টাকার দ্রুত অবমূল্যায়নের ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়ে পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠান এই ব্যয় বাড়তি দাম হিসেবে গ্রাহকের ওপর চাপাতে না পারায় তাদের মুনাফা হ্রাস পায়।
ঋণের উচ্চ সুদের হারও মুনাফা হ্রাসের একটি বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। উৎপাদনশীল অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণের ওপর নির্ভরশীল। সুদের হার বাড়ায় তাদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, ব্যাংক খাত এ সুযোগে লাভবান হয়েছে, কারণ তারা ঋণের মাধ্যমে অতিরিক্ত আয় করেছে। যদিও এটি ব্যবসার জন্য ঋণ নেওয়াকে আরও ব্যয়বহুল করে তুলেছে।
রূপালী চৌধুরী আরও বলেন, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে শর্তসাপেক্ষে এলসি খোলার বিধিনিষেধের ফলে ব্যবসায়িক সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগে বড় ধরনের বাধা এসেছে। এই কারণে অনেকে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা স্থগিত করেন। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান আমদানি করা কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল, তারা বিনিময় হারের অস্থিরতার কারণে অতিরিক্ত খরচের মুখে পড়েছে।
ব্যবসার অন্যতম বড় বাধা হিসেবে ক্রেতাদের আস্থার অভাবকে দায়ী করেন তিনি। অনিশ্চয়তার সময়ে ক্রেতারা খরচ কমিয়ে দেন, ফলে বাজারে চাহিদা হ্রাস পায়। নির্মাণ খাতে মন্দার প্রভাবে ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে, ভোগ্যপণ্য (FMCG) খাতে কিছুটা মিশ্র ফল দেখা গেছে; যদিও সাধারণত এই খাত ভালো করে, তবুও প্রবৃদ্ধির গতি মন্থর।
তবে আশার কথাও রয়েছে। রূপালী চৌধুরী জানান, ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে অর্থনীতিতে কিছু চাঙ্গাভাব লক্ষ্য করা গেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, রপ্তানিও দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। যদিও কিছু পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, তবুও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
তিনি পুঁজিবাজার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব স্পষ্ট। এমনকি ভালো মানের প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দরও কমছে। এর পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করা জরুরি। সরকারকে অবশ্যই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে এবং ব্যবসা সহায়ক নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মিরসরাইয়ে বার্জার পেইন্টসের ৮০০ কোটি টাকার বিনিয়োগসহ নতুন কারখানা ও প্রযুক্তি আনার উদ্যোগ এর প্রমাণ। কোরিয়ান ইপিজেডে দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধান হওয়াকে তিনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ইতিবাচক বার্তা হিসেবে দেখেন।
তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য রূপালী চৌধুরী কিছু নীতিগত সংস্কারের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, কমপ্লায়েন্সের খরচ কমিয়ে আনলে আরও প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে আসতে উৎসাহিত হবে। পুঁজিবাজার পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে সরকার গঠিত টাস্কফোর্স এরইমধ্যে বিএপিএলসি থেকে কিছু প্রস্তাব পেয়েছে। তিনি স্বতন্ত্র পরিচালকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করা এবং যোগ্যদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়ার আহ্বান জানান।
রূপালী চৌধুরী সরকারকে পূর্বানুমানযোগ্য কর নীতি অনুসরণ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, হঠাৎ করে কর কাঠামো পরিবর্তনের ফলে ব্যবসায়িক অস্থিরতা তৈরি হয়। তিনি কর ব্যবস্থাকে স্বয়ংক্রিয় করে দুর্নীতি হ্রাস এবং স্বচ্ছতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন। আমদানি শুল্ক হিসাবের ক্ষেত্রে অসঙ্গতির কথা তুলে ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী তথ্য সমন্বয়ের পরামর্শ দেন।
সবশেষে তিনি বলেন, সুদের হার বেশি থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠান নগদ অর্থের সংকটে পড়ে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে ক্রেতাদের খরচ বাড়াতে হবে। তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।” ব্যাংকিং খাতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ এখনো উদ্বেগের বিষয়। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে সরকার কিছু সংস্কার আনছে। যদি ডলারের বিনিময় হার ও রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকে, তবে ধীরে ধীরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও ফিরবে।