
প্রতিবেদক: দীর্ঘদিন ধরেই সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার নিম্নমুখী। সরকার পরিবর্তনের পর সাময়িকভাবে বিক্রি কিছুটা বাড়লেও ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে আবারও তা কমতে শুরু করে, যা ধারাবাহিকভাবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে নিট বা প্রকৃত সঞ্চয়পত্র বিক্রি ছিল ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা ঋণাত্মক। অর্থাৎ ওই মাসে যত সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি টাকা সরকারকে পূর্বে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ ও মূলধন পরিশোধ করতে হয়েছে, যা কোষাগার বা ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে মেটানো হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে এই নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা ঋণাত্মক।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয় দিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে, সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ থাকছে না। যার ফলে মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনতেও পারছে না। জনগণের সঞ্চয় সক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় জানুয়ারিতে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়ানো হয়। মুনাফার হার বৃদ্ধি পেয়ে সর্বোচ্চ ১২.৫৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’-এর সুদ ১১.৫২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২.৫০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা এবং একই সময়ে ভাঙানো হয়েছে ৮ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। এতে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে ৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। নভেম্বর মাসে বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা, ভাঙানো হয়েছিল ৮ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, ফলে নিট ঋণাত্মক হয় ৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। অক্টোবর মাসে বিক্রি হয় ৫ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা, আর ভাঙানো হয় ৯ হাজার ৮৩ কোটি টাকা, অর্থাৎ নিট ঋণাত্মক ছিল ৩ হাজার ২২৪ কোটি টাকা।
তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস কিছুটা ভিন্ন ছিল। জুলাই মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৯১১ কোটি টাকা এবং ভাঙানো হয়েছিল ২ হাজার ৭২৪ কোটি, ফলে নিট বিক্রি ছিল ২ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। আগস্টে বিক্রি হয় ৪ হাজার ১১২ কোটি, ভাঙানো হয় ২ হাজার ৭৬ কোটি, নিট বিক্রি ছিল ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ নিট বিক্রি হয় – ৫ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকার বিক্রির বিপরীতে ১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা ভাঙানো হয়েছিল, ফলে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা।
এই পরিস্থিতি নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মানুষ সঞ্চয় করতে পারছে না, বরং অনেকেই ধার করে সংসার চালাচ্ছেন। তাঁর মতে, মুনাফার হার কমে যাওয়া, নানা অর্থনৈতিক কড়াকড়ি এবং আয় হ্রাস পাওয়ায় মানুষ বাধ্য হয়ে আগের সঞ্চয়পত্র ভাঙাচ্ছে। ফলে নিট বিক্রি নেগেটিভ হচ্ছে। এমনকি রেমিট্যান্স প্রবাহও কম থাকায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই থেকে জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৭ হাজার ১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা ঋণাত্মক ছিল। অর্থাৎ, এই সময়ে যত সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে এই পরিমাণ বেশি টাকা সরকারকে আগের সঞ্চয়পত্রের সুদ ও মূলধন পরিশোধে দিতে হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে (২০২৩-২৪) নিট বিক্রি ছিল ৭ হাজার ৩৫০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ঋণাত্মক।
এভাবে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ ও আসল পরিশোধ করে যা অবশিষ্ট থাকে, সেটিই নিট বা প্রকৃত বিক্রি। সরকার সাধারণত এই নিট অর্থ কোষাগারে জমা রেখে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যবহার করে এবং সঞ্চয়পত্রধারীদের প্রতি মাসে সুদ প্রদান করে থাকে। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মক থাকায় সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ নিতে পারেনি, বরং কোষাগার থেকে ৭ হাজার ১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির ওপর আরও বেশি নির্ভর করতে চায়। এ কারণে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মানুষের হাতে পর্যাপ্ত সঞ্চয় না থাকায় মুনাফা বাড়ানোয় তেমন সুফল আসছে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ নিতে না পারায় বরং আগের সুদ-আসল পরিশোধে দিতে হয়েছে ২১ হাজার ১২৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।