
প্রতিবেদক: মাত্র ছয় মাস আগে ফ্রিজ ও এয়ার-কন্ডিশনার (এসি) প্রস্তুতকারকদের ওপর করপোরেট কর দ্বিগুণ করার পর এবার এই খাতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। ফলে প্রচণ্ড গরমের এই সময়ে ভোক্তাদের ওপর আর্থিক চাপ আরও বাড়বে, যখন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে উৎপাদন পর্যায়ে ফ্রিজ ও এসির ওপর ৭.৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়, যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাড়িয়ে স্ট্যান্ডার্ড রেট ১৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করছে।
একইভাবে, মোবাইল ফোন উৎপাদনে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের ভিত্তিতে থাকা ৫ ও ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে ৭.৫ ও ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। ব্যাটারি উৎপাদনেও বিদ্যমান ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট দ্বিগুণ হতে পারে।
বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ইতিমধ্যেই বাজারে চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে। এর মাঝে ভ্যাট বাড়ানো হলে বিক্রি আরও কমে যেতে পারে, এবং শেষ পর্যন্ত এর ভার ভোক্তাদের ওপরই পড়বে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী মাসের শুরুতে অর্থ উপদেষ্টার কাছে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদনের পর এটি কার্যকর হবে। তাঁরা জানান, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর চাপেই কর অব্যাহতি কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা জানান, “রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার ও এসি উৎপাদনে বিদ্যমান হ্রাসকৃত ভ্যাট সুবিধার মেয়াদ জুনে শেষ হচ্ছে এবং তা আর না বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আইএমএফ এক্সেম্পশন কমানোর ওপর জোর দিয়েছে, আর এই শিল্পগুলো ইতিমধ্যেই ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে সুবিধা ভোগ করেছে, এখন তারা স্বনির্ভর।”
২০০৯ সাল থেকে সরকার স্থানীয় শিল্প বিকাশে ভ্যাট ও কর ছাড় দিয়ে আসছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ফ্রিজ উৎপাদনে কোনো ভ্যাট ছিল না। এখনও কিছু কম্পোনেন্ট আমদানি ও স্থানীয় সংগ্রহে ভ্যাট ছাড় চালু আছে। এই প্রণোদনার ফলে দেশীয়ভাবে বর্তমানে বাজারের ৯৫ শতাংশ ফ্রিজ উৎপাদিত হচ্ছে।
তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে করপোরেট কর ১০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত করায় বেশ কয়েকটি কোম্পানি আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে — যা এখন বিচারাধীন।
ফেয়ার গ্রুপের চিফ মার্কেটিং অফিসার মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেন, “গত তিন বছরে ফ্রিজ বিক্রিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি (ডিগ্রোথ) হয়েছে, যদিও এসি বিক্রি বেড়েছে ১২ শতাংশ। তবে চলতি বছরে মোবাইল ফোন বিক্রি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে উৎপাদন পর্যায়ে ৭.৫ শতাংশ ও ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। সব মিলিয়ে ভ্যাটের চাপ প্রায় ১০ শতাংশ। উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশ হলে ভোক্তা পর্যায়ে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ প্রভাব পড়বে।”
অন্যদিকে, কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, “ফ্রিজ ও এসি শিল্প প্রায় দেড় দশক ধরে সরকারি সহায়তা পেয়েছে। এখন তারা অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই, সরকার ধাপে ধাপে কর অব্যাহতি কমিয়ে আনতে পারে।”
এক সময় বিলাসপণ্য হিসেবে বিবেচিত ফ্রিজ এখন সাধারণ গৃহস্থালী সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধা বিস্তৃতি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দেশীয় সাশ্রয়ী ব্র্যান্ডের উত্থান এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ফ্রিজ বাজারের আকার ১২,০০০ কোটি টাকার বেশি, বছরে বিক্রি হয় প্রায় ৩৩–৩৫ লাখ ইউনিট, এবং বাজারটি প্রতি বছর গড়ে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ওয়ালটন, যমুনা ইলেকট্রনিক্স, ভিশন (প্রাণ-আরএফএল), ও সিঙ্গার বাংলাদেশ বাজারে মূলত আধিপত্য করছে।
অন্যদিকে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসি বিক্রি হয়েছে ৬.২ লাখ ইউনিট, এবং এই বাজারের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৪ শতাংশ। এসি এখন আর বিলাসপণ্য নয়, বরং একপ্রকার প্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
দেশের এসি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রো মার্ট, যারা গ্রি ব্র্যান্ডের এসি বাজারজাত করছে, তাদের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আফসার জানান, “বর্তমানে এক টনের একটি গ্রি এসির দাম ৫৯,২০০ টাকা। ভ্যাট বাড়লে প্রতি ইউনিটে অতিরিক্ত ৩ হাজার টাকা ভোক্তাকে গুনতে হবে।
তিনি বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম, এবছর গরমে বিক্রি বাড়বে। কিন্তু তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে কম এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে বিক্রি প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েছে।”
তাঁর মতে, ভ্যাট বাড়ানো হলে তা ধাপে ধাপে করা উচিত ছিল, যাতে ভোক্তাদের জন্য মানিয়ে নেওয়া সহজ হতো।
ফ্রিজ বাজারে ওয়ালটন এককভাবে সবচেয়ে বড় হিস্যা রাখলেও প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট সংক্রান্ত বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
গত কয়েক বছরে এনবিআর ধারাবাহিকভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট নির্মাতাদের ওপর ভ্যাট বাড়িয়েছে। বর্তমানে, যারা স্থানীয়ভাবে কমপক্ষে দুটি কম্পোনেন্ট তৈরি করে, তাদের জন্য ৫ শতাংশ, আর যারা সম্পূর্ণ আমদানিকৃত উপকরণ ব্যবহার করে, তাদের জন্য ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এনবিআরের পরিকল্পনা অনুযায়ী, উভয় হারে ২.৫ শতাংশ করে বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
ট্রান্সসিয়ন বাংলাদেশের সিইও রেজওয়ানুল হক (টেকনো, আইটেল, ইনফিনিক্স ব্র্যান্ডের স্থানীয় প্রতিনিধি) বলেন, বর্তমানে দেশের মোবাইল ফোনের গ্রে মার্কেটের আকার প্রায় ৫০ শতাংশ। যদি ভ্যাট বাড়িয়ে গ্রে মার্কেট বন্ধ না করা হয়, তাহলে আইনি ও অবৈধ পণ্যের দামের পার্থক্য আরও বাড়বে এবং ভোক্তারা অবৈধ ফোনের দিকে ঝুঁকবে।”
তিনি বলেন, একদিকে বৈধ হ্যান্ডসেটের দাম বাড়বে, অন্যদিকে গ্রে মার্কেট আরও বিস্তৃত হবে, যা সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিবর্তে ক্ষতি ডেকে আনবে।”
২০২৪ সালে দেশে ৭৯ লাখ স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছে জানিয়ে তিনি সতর্ক করেন, চলতি বছরে বিক্রি ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে, যদি ভ্যাট বাড়ানো হয় এবং অবৈধ পণ্যের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়।
ফেয়ার গ্রুপের চিফ মার্কেটিং অফিসার মেসবাহ উদ্দিন বলেন, “ক্রমান্বয়ে ট্যাক্স বাড়ানো হলে— স্থানীয় শিল্প আরও ঝুঁকিতে পড়বে, বিক্রি কমে যাবে, এবং অবৈধ পণ্যের চাহিদা বাড়বে। সরকার যদি গ্রে মার্কেট বন্ধ না করে কেবল ভ্যাট বাড়াতে থাকে, তাহলে রাজস্ব আদায় বাড়বে না, বরং উল্টো ক্ষতি হতে পারে।