
প্রতিবেদক: তাজমা সিরামিক শুধুই একটি কারখানার নাম নয়, বরং বগুড়ার মাটি ও শ্রমিকদের হাতের ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সিরামিক শিল্পের সূচনালগ্নের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ১৯৫৮ সালে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে। তৎকালীন পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের তৈরি চীনামাটির তৈজসপত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু সময়ের প্রবাহে এবং ফার্নেস অয়েলের সংকটে পড়ে ২০০১ সালে বন্ধ হয়ে যায় এই ঐতিহাসিক কারখানা, যা ছিল এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের ক্ষণিক পতন।
প্রায় আট বছর বন্ধ থাকার পর ২০০৯ সালে গ্যাস সংযোগ পাওয়ার পর আবারও ঘুরে দাঁড়ায় তাজমা সিরামিক। চীনের কারিগরি সহায়তায় নতুন রূপে শুরু হয় পথচলা। পুরোনো দিনের পরিচিত পণ্যের সঙ্গে যুক্ত হয় আধুনিক ডিজাইন ও প্রযুক্তির ছোঁয়া। বর্তমানে তাজমা সিরামিক প্লেট, কাপ, গ্লাস, মগ, বাটি, জগ থেকে শুরু করে ফুলদানি ও শোপিসসহ প্রায় ৬০ ধরনের পণ্য উৎপাদন করে। বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার বাজার তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি, যা শুধু বগুড়ার নয় বরং জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এখানে কাজ করেন প্রায় ২৫০ কর্মী, যাদের অধিকাংশই নারী। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তাজমা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বর্তমান কর্ণধার মোহাম্মদ শরিফুজ্জামান বলেন, প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। চলতি মূলধনের ঘাটতি, পুরোনো যন্ত্রপাতি এবং গ্যাসের পুরোপুরি ব্যবহার করতে না পারাসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তিনি জানান, সরকার সহযোগিতা করলে তাজমা আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
তাজমার জন্মযাত্রা শুরু হয় নওগাঁর রানীনগরের খাজুরিয়াপাড়া গ্রামের আবদুল জব্বারের হাত ধরে। চল্লিশের দশকে কাজের সন্ধানে বগুড়ায় পাড়ি জমান তিনি। প্রথমে ভাণ্ডারি বিড়ি ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে তিন ভাইয়ের সহায়তায় নিজ গ্রামে ‘কল্যাণ বিড়ি’ ও ‘পাক বিড়ি’ নামে একটি বিড়ি কারখানা গড়ে তোলেন, যা অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বিড়ির ব্যবসায় সফল হয়ে আবদুল জব্বার বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ১৯৫৮ সালে চার ভাইয়ের ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে গঠিত ‘তাজমা’ নামের সিরামিক কারখানা স্থাপন করেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি নিজেই। কঠোর পরিশ্রম ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে তিনি এক নতুন শিল্পের ভিত্তি গড়ে তোলেন।
বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান চ্যালেঞ্জ—ডলার সংকট ও টাকার অবমূল্যায়নের ধাক্কা সিরামিক শিল্পকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাজমা এর ব্যতিক্রম নয়। এ অবস্থায় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মূলধন সংকট, গ্যাস সরবরাহ এবং আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন।
বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সিরামিক বাজারে তাজমা হয়তো বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম নয়, তবে প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহ্য, গুণগত মান ও দীর্ঘ ইতিহাস একটি শক্ত ভিত্তি হিসেবে রয়ে গেছে। বহু সংকটের মধ্যেও টিকে রয়েছে তাজমা সিরামিক।
শ্রমিক থেকে শিল্পপতি হওয়া আবদুল জব্বারের স্বপ্ন আজও বহন করে চলেছে তাজমা। এটি কেবল একটি উৎপাদন ইউনিট নয়, বরং দেশের শিল্পায়নের ইতিহাসে এক অমূল্য দলিল।