এক দরজায় বিনিয়োগ সেবা: ছয় সংস্থা একীভূত করার পথে সরকার

প্রতিবেদক: দেশে বিনিয়োগ কার্যক্রম সহজ ও সমন্বিত করতে ছয়টি বিনিয়োগ–সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে একটি যাচাই কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা প্রস্তাবটি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে মতামত দেবে। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। যদিও সরকারের এই উদ্যোগকে অনেকেই স্বাগত জানালেও সংশ্লিষ্ট কিছু সংস্থা ও বিদেশি বিনিয়োগকারীর মধ্যে আপত্তির সৃষ্টি হয়েছে।

যে ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করার প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো হলো: বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ), পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ কর্তৃপক্ষ (পিপিপিএ) এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ অনুমোদন, নিবন্ধন, জমি বরাদ্দসহ নানা সেবা পেতে বিনিয়োগকারীদের একাধিক সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। এতে সময় ও হয়রানি বাড়ে। দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়ীরা এসব নিয়ে অভিযোগ করে আসছেন। তাদের মতে, বিনিয়োগ–সম্পর্কিত সব সেবা যদি একটি মাত্র সংস্থা থেকে পাওয়া যেত, তাহলে প্রক্রিয়াটি আরও সহজ হতো। সেই ভাবনা থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে।

গত ১৩ এপ্রিল বিডার গভর্নিং বোর্ডের সভায় একীভূতকরণের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিডা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রস্তাবটির যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয় এবং সেই অনুযায়ী ৩০ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানকে আহ্বায়ক এবং বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান এবং অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার।

তবে এই উদ্যোগ নিয়ে আপত্তি তুলেছে একাধিক বিদেশি বিনিয়োগকারী ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। উত্তরা ইপিজেডে ১৪ বছর ধরে ব্যবসা করা একটি চীনা কোম্পানি ২৩ এপ্রিল চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, বেপজার বিনিয়োগ–সহায়ক নীতির কারণে তারা এখানে বিনিয়োগ করেছে। এখন সংস্থাগুলো একীভূত হলে তাদের জন্য অনিশ্চয়তা তৈরি হবে এবং ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হবে। একইভাবে, ঢাকা ইপিজেডে কার্যক্রম পরিচালনাকারী আরেকটি চীনা কোম্পানি ২৭ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে একীভূতকরণের উদ্যোগ স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের মতে, বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া অনুচিত।

বেজা, বেপজা ও হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তাও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, এসব সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন আইনের আওতায় পরিচালিত হয় এবং তাদের কাজের ধরন, সেবার পরিধি ও সক্ষমতায় রয়েছে অনেক পার্থক্য। যেমন বিডা নিবন্ধন দিলেও জমি বরাদ্দ দিতে পারে না, অথচ বেজা ও বেপজা জমি বরাদ্দ দেয়। আবার বেপজা কেবল রপ্তানিমুখী শিল্পের সেবা দেয়। তাই একীভূতকরণে বাস্তব সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাদের মতে, বরং একটি একক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম (One-Stop Service – OSS) তৈরি করলে বিনিয়োগকারীরা সব সেবা এক জায়গা থেকে পেতে পারেন।

অন্যদিকে, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও শাশা ডেনিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ এই উদ্যোগকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি মনে করেন, এতে বিনিয়োগকারীরা দ্রুত ও সহজে সেবা পাবেন এবং সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও সুবিধা হবে। তবে তিনি মনে করেন, বেপজাকে এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়া থেকে আলাদা রাখা উচিত।