ব্যাংক খাতে রেকর্ড মূলধন ঘাটতি, হুমকিতে আর্থিক স্থিতিশীলতা

প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে বছরের পর বছর ধরে চলা লাগামহীন অনিয়মে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ মূলধন সংকটে পড়েছে। এই সংকট এখন পুরো আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকেই হুমকির মুখে ফেলেছে। ব্যাংকগুলোর মূলধন পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঝুঁকি জনিত সম্পদের অনুপাত (সিআরএআর) নেমে এসেছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশে, যেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বাসেল থ্রি অনুযায়ী এই হার হওয়া উচিত কমপক্ষে ১০ শতাংশ। মাত্র তিন মাস আগেও এই অনুপাত ছিল ৬.৮৬ শতাংশ এবং ২০২৪ সালের জুনে ছিল ১০.৬৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত, ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, যেখানে সিআরএআর ঋণাত্মক অবস্থানে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সিআরএআর ছিল ঋণাত্মক ৮.৪২ শতাংশ, ইসলামি ব্যাংকের ছিল ঋণাত্মক ৪.৯৫ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকের ছিল ঋণাত্মক ৪১.০২ শতাংশ। অন্যদিকে, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সিআরএআর ছিল ১০.৯৮ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংকের ছিল ৪২.০৯ শতাংশ, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যাংকের গোপন খারাপ ঋণ প্রকাশ্যে আসে। এর ফলে তারা আরও বড় মূলধন সংকটে পড়ে। সেই বছরের শেষ নাগাদ মোট ১৯টি ব্যাংক, যার মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত, সম্মিলিতভাবে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়ে। এই ঘাটতির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।

জনতা ব্যাংক সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত। ২০২৪ সালের শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকায়। এই ঘাটতির মূল কারণ হচ্ছে ৬৭ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত মোট ঋণের ৭২ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের মধ্যে রয়েছে আননটেক্স, ক্রিসেন্ট, বেক্সিমকো, থারম্যাক্স ও এস আলম গ্রুপ। এই গ্রাহকদের সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৮,১৮৮ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৫,১০০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৪,৬৮৫ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৩,১৫০ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ২,৪০০ কোটি টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১৫,৬৮৯ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১৩,৯৯১ কোটি, ইসলামী ব্যাংকের ১২,৮৮৫ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১১,৭০৮ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ৯,০০০ কোটি এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের ৭,৭০০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া পদ্মা ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ৪,৯০০ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ২,৯০০ কোটি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১,৯০০ কোটি, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১,৬০০ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১,৫০০ কোটি, এবি ব্যাংকের ৫০০ কোটি এবং আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ২৫০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, খারাপ ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঋণের টাকা ফেরত না আসায় প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যায়। এর ফলে মূলধন ঘাটতিও বহু গুণ বেড়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে তাদের পরিচালন মুনাফার একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়, যা যথাযথভাবে না রাখলে মূলধনের ওপর চাপ পড়ে।

এদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন করে পুঁজিঘাটতির তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও কয়েকটি ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই পূর্বতন সরকারের রাজনীতিসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর প্রভাবাধীন ছিল।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউজ্জামান বলেন, প্রভিশনিং নীতিমালা শিথিল করা, এস আলমের শেয়ার বিক্রি এবং পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলধন সংকট কিছুটা নিরসন করা যেতে পারে।

এক বেসরকারি ব্যাংকের সিইও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি প্রভিশন সুবিধা অব্যাহত রাখে, তাহলে মূলধন ঘাটতি কিছুটা কমতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করেন যে, পূর্বতন সরকারের সময় দুর্বল ব্যাংকগুলো এই সুবিধার অপব্যবহার করে মূলধন ঘাটতি গোপন করেছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংক সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূলধন ঘাটতি দূর করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো পুনরায় মূলধন জোগাড় করা। তবে তার আগে ব্যাংকগুলোর মধ্যে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করতে হবে। তিনি বলেন, “সরকার যদি মূলধন পুনঃবিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোতে অর্থ ঢালার আগে সেগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।”