
প্রতিবেদক: বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ায় মূলধন ঘাটতিও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ২০টি ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকায়, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এই ঘাটতি ছিল ৫৩ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ঘাটতি বেড়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। নতুন করে আরও চারটি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাসেল-৩ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন।
এক বছর আগে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ১০টি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৩৯ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময়ে ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের সম্মিলিত মূলধন ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের অনুপাত (সিআরএআর) নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশে, যা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম মানের অনেক নিচে। অথচ সেপ্টেম্বর শেষে এটি ছিল ৬.৮৬ শতাংশ।
ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংককে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের কমপক্ষে ১০ শতাংশ বা ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সে পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক। এই মূলধন মূলত উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগ ও ব্যাংকের মুনাফা থেকে আসে। কোনো ব্যাংক এই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে সেটিকে মূলধন ঘাটতিতে পড়া ব্যাংক হিসেবে গণ্য করা হয়।
মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান করতে পারে না। তাছাড়া, বিদেশি ব্যাংক ও বিনিয়োগকারীরা ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের আগে এসব ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য যাচাই করে, ফলে ঘাটতির প্রভাব আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও পড়ে।
মূলধন ঘাটতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক, যার ঘাটতির পরিমাণ ৫২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (১৮,১৮৮ কোটি), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (১৩,৯৯১ কোটি), ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (১২,৮৮৫ কোটি), এবং ন্যাশনাল ব্যাংক (৭,৭৯৮ কোটি)।
২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। একই সময়ে মন্দ ঋণের বিপরীতে ১৩টি ব্যাংকের সম্মিলিত প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা।
এই ঘাটতি ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে, যার ফলে পুরো ব্যাংক খাতে নতুন করে মূলধন ঘাটতির চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ সালের মার্চের শেষে এই ঘাটতির চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে। কারণ মার্চ থেকে প্রভিশনিং হার আরও কঠোর করা হয়েছে। আগে এসএমএ শ্রেণির ঋণের জন্য প্রভিশন হার ছিল ১ শতাংশ, যা মার্চ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ শতাংশে।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, মূলধন ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আদায়ে সক্রিয় হতে হবে এবং নতুন মূলধন সংযোজন করতে হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি প্রভিশন স্থগিত সুবিধা দেয়, তাহলে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে। কিছু ব্যাংককে শর্তসাপেক্ষে এই সুবিধা দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। কিছু ব্যাংক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে যারা ব্যর্থ হবে, তারা একীভূত (merger) হওয়ার পথে বাধ্য হতে পারে।