ব্যাংক খাতের দুর্দশা কাটেনি, বদলেছে চিত্র

প্রতিবেদক: ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট ও অনিয়মের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রভাব ও দুর্বল তদারকির কারণে বহু ব্যাংক পরিচালনা সংকটে পড়ে। তবে সরকার পরিবর্তনের পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো পূর্ণ আস্থা ফিরে আসেনি ব্যাংকিং খাতে।

নতুন সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করে। উদ্দেশ্য ছিল, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার শিকার ব্যাংকগুলোর সংস্কার। তবে এর মধ্যে ৬টি ব্যাংক এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অনেক গ্রাহক এখনো ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। যদিও আগের মতো আতঙ্ক নেই, তারপরও ব্যাংক খাতের সব আর্থিক সূচক এখনো দুর্বল।

অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর—এই তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে, কমেছে ঋণের চাহিদাও।

নজরদারি বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকার ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ অনুমোদন দিয়েছে। এর আওতায় ব্যাংক একীভূত, অধিগ্রহণ ও অবসায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অর্ডার সংশোধনের কাজও চলছে। তবে এখনো এসব পদক্ষেপ বাস্তব রূপ পায়নি। গ্রাহকেরা নির্বিঘ্নে লেনদেন করতে পারছেন না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অনেক ব্যাংক এখনো নামসর্বস্ব ঋণ আদায় করতে পারছে না। অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কিছুটা সক্রিয় হলেও অর্থ আত্মসাতে জড়িত অনেক ব্যক্তি এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

একই সঙ্গে অভিযোগ উঠছে, আগের মতো এখনো রাজনৈতিক চাপ আছে। যেমন, অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর প্রভাব বিস্তার করতেন ক্ষমতাবানরা, তেমনি এখন বিএনপির কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে চাপ দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষা করছে বিদেশি নিরীক্ষকের মাধ্যমে। বিশেষ করে ৬টি ইসলামি ধারার ব্যাংক—সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, আইসিবি ইসলামী, এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি ও ইউনিয়ন ব্যাংক—এই ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ, অধিগ্রহণ এবং বিদেশি ও দেশি শক্তিশালী বিনিয়োগকারী এনে সংস্কারের পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার পরিবর্তনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে, যা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। যদিও ব্যাংকগুলোতে এখনো বাস্তবায়নযোগ্য কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, ব্যাংক খাতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা অপূরণীয় হলেও বর্তমান সরকার তা থামাতে সক্ষম হয়েছে। এখন দরকার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এবং বিনিয়োগে গতি আনানো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুনাফা কে মুজেরী বলেন, ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু ঘোষণা দিয়ে বাস্তব পরিবর্তন সম্ভব নয়। ব্যবসার জন্য ঋণ সহজলভ্য করতে হবে এবং কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ব্যাংক খাতে অনিয়মের সূত্রপাত হয়। প্রথম মেয়াদে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং বেসিক ব্যাংকে বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। ওই সময় সরকারের উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়।

দ্বিতীয় মেয়াদে এস আলম গ্রুপ ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় ধরনের অর্থ লুটপাট করে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এসব ব্যাংকে তহবিল জোগান দেয়। আওয়ামী ঘনিষ্ঠ আরও অনেকেই নামে-বেনামে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করে।

সেই সময় খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হতো। সরকার বদলের পর বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ধারা থেকে সরে এসে বাস্তব চিত্র প্রকাশ করছে। বর্তমানে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরেই খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়। মাত্র ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০০৯ সালে এ পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি প্রমাণ করে ব্যাংক খাতের ওপর সরকারের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও লুটপাট কতটা ক্ষতিকর ছিল। এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ব্যাংক খাতের আস্থা পুনঃস্থাপন এবং অর্থনীতির মূলধারায় বিনিয়োগ ফেরানো।