
প্রতিবেদক: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকার আপাতত দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই দুটি খাতকে কৌশলগত পণ্য বিবেচনায় নিয়ে এবং বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে শুল্ক-কর কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে খরচ কমে আসে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব খাতে বেশ কয়েকটি শুল্ক ও কর হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে কয়েক হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। গত সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সংসদে এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
অর্থ উপদেষ্টা জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকি কমাতে উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যা সফল হলে বছরে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব হবে। গ্যাস খাতেও শুল্ক ও ভ্যাট হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এলএনজি আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে পেট্রোবাংলার ভর্তুকির চাপ ৬ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত কমতে পারে।
এছাড়া গ্যাস বিতরণ সংস্থাগুলোর উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৬ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা খরচ ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনবে। এতে তিতাস ও বাখরাবাদের মতো কোম্পানিগুলোর আর্থিক ভারসাম্য উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান বলেছেন, আমদানি খরচ কমে গেলে আরও বেশি কার্গো আনা সম্ভব হবে, ফলে শিল্পে গ্যাস সংকট দূর হবে এবং সরবরাহ বাড়বে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হয় সরকারকে। এ খাতে খরচ কমাতে বিদ্যুৎ কেনার বিলের ওপর উৎসে কর ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে, যা পিডিবির বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয়ে সহায়তা করবে। যদিও পিডিবি পুরোপুরি কর প্রত্যাহার চেয়েছিল, যার ফলে সাশ্রয় হতো ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এতদিন নির্ধারিত মূল্যের ভিত্তিতে শুল্ক দিত, যা পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছে। এখন প্রস্তাব অনুযায়ী তেলের প্রকৃত ক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে শুল্ক আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে বিপিসির কিছুটা বাড়তি খরচ হতে পারে। তবে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ এবং পরিশোধিত জ্বালানি তেলের শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে শুল্ক আদায়ে বড় পরিবর্তন হবে না এবং বিপিসির খরচে বড় প্রভাব পড়বে না।
এতে বেসরকারি আমদানিকারকদের ক্ষেত্রে আমদানি ব্যয় কিছুটা কমবে। কারণ, তারা আগে থেকেই ইনভয়েস ভ্যালু অনুযায়ী শুল্ক দিত। পাশাপাশি এলপিজির সিলিন্ডার উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যদিও সুবিধার পরিমাণ কিছুটা হ্রাস করা হয়েছে।
জ্বালানি খাতের অব্যাহত সংকট সত্ত্বেও আগে বরাদ্দ কম থাকত, এবার অন্তর্বর্তী সরকার সেই খাতে জোর দিয়েছে। বাজেটে জ্বালানি খাতের বরাদ্দ দ্বিগুণ করে ২ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে উন্নয়ন বরাদ্দ ২ হাজার ৮৬ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ কমেছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এই খাতে ২১ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও, প্রস্তাবিত বাজেটে তা কমিয়ে ২০ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা করা হয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, অতীতে বাড়তি শুল্ক ও করের বোঝা সাধারণ ভোক্তার ওপর চাপানো হতো। বিদ্যুতের দাম না বাড়ানো এবং এলএনজির শুল্ক প্রত্যাহার ভালো দিক। তবে তিনি সতর্ক করেন, জ্বালানি তেল থেকে রাজস্ব আদায় যেন বৃদ্ধি না পায় এবং বরাদ্দ বাড়লেও প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
তার মতে, জ্বালানি খাতে সুবিচার নিশ্চিত করতে বাজেটে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই।