ফেলনা থেকে রপ্তানি পণ্য: গ্রামের কারখানায় গড়ে উঠছে বৈদেশিক আয় ও কর্মসংস্থান

প্রতিবেদক: কয়েক বছর আগেও যেসব বস্তু ফেলনা হিসেবে ফেলে দেওয়া হতো—যেমন পেঁপেগাছের ডালপালা বা নল, আমগাছ ও নিমগাছের চিকন ডাল, পাটচুন ঘাস কিংবা নীলকণ্ঠ ফুল—সেসব এখন রপ্তানি পণ্যে পরিণত হয়েছে। এসব ব্যবহার করে তৈরি হচ্ছে পোষা প্রাণীর খাবার ও খেলনা। এর মাধ্যমে দেশে আসছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা।

এই উদ্যোগের পেছনে রয়েছেন মাগুরার জাগলা গ্রামের উদ্যোক্তা রহমতুল ইসলাম। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে পড়াশোনা ও ব্যবসা শেষে দেশে ফিরে ২০১৮ সালে এই কারখানা স্থাপন করেন। শুরুতে মাত্র চার–পাঁচজন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন মাগুরার গ্রামে গড়ে ওঠা ‘বোল্ড পার্টনারস লিমিটেড’–এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ৫০০ জন। এর মধ্যে অধিকাংশই সুবিধাবঞ্চিত নারী। কারখানার পাশাপাশি প্রায় ২০ একর জমিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের উৎস হিসেবেও গাছ ও ঘাস রোপণ করেছেন তিনি।

প্রথম রপ্তানি হয় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, জাপানে তিন হাজার ডলারের পোষা প্রাণীর খেলনা। এর পর থেকে রপ্তানি বাড়তে থাকে এবং কর্মসংস্থানের প্রয়োজনও বাড়ে। কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং গ্রামের নারীরা অগ্রাধিকার পেতে শুরু করেন। শুধু কারখানা নয়, আশপাশের গ্রামের লোকজন ফেলনা পণ্য সরবরাহ করে নগদ টাকা উপার্জন করছেন। এমন সরবরাহকারীর সংখ্যা এখন প্রায় ১০০।

সবচেয়ে চাহিদা সম্পন্ন কাঁচামাল হয়ে উঠেছে পেঁপেগাছের ডাল। এ জন্য বোল্ড পার্টনারস লিমিটেড তাদের ফেসবুক পেজে বিজ্ঞাপন দিয়ে পেঁপের নল সংগ্রহের আহ্বান জানিয়েছে। ডালের কোনো কাজে না লাগা অংশ এখন রীতিমতো আয় করার উৎস। রহমতুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন, কারখানায় কোনো কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় না। আবার কারখানায় কোনো বর্জ্যও তৈরি হয় না। ঘাস ও গাছের ব্যবহারযোগ্য অংশ দিয়ে খাবার ও খেলনা তৈরি হয়; আর অবশিষ্ট অংশ হয় গরুর খাবার।

এই কারখানায় চারটি ভাগে বিভক্ত কাজ চলে: পোষা প্রাণীর পোশাক, কুকুর–বিড়ালের খেলনা, পোষা প্রাণীর খাবার ও স্ন্যাকস এবং ছোট প্রাণীদের (খরগোশ, গিনিপিগ, ইঁদুর) জন্য খাবার ও খেলনা। পেঁপের নল থেকে তৈরি হয় খরগোশ ও গিনিপিগের খাবার, আর নিমগাছের ডাল ব্যবহৃত হয় কুকুরের দাঁত পরিষ্কারে। ঘাস দিয়ে তৈরি ইঁদুরের ঘর রপ্তানি হচ্ছে কানাডায়।

কারখানার ব্যবস্থাপক মুন্সী তোহা হাসান জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত তারা পোষা প্রাণীর ৩৫০ রকমের পণ্য তৈরি করেছেন, এবং এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সাড়ে ৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা টাকায় প্রায় সাড়ে ৫ কোটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট রপ্তানি প্রায় ২৭ লাখ ৩৬ হাজার ডলার। রপ্তানির বড় বাজার হলো জাপান, এরপর কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়া।

এই উদ্যোগ শুধু বৈদেশিক আয় নয়, গ্রামের মানুষের জীবনমানও বদলে দিয়েছে। অনেকে চাকরির আয় দিয়ে ঘর তুলেছেন, গরু–ছাগল কিনেছেন কিংবা নতুন আয় শুরু করেছেন। সরবরাহকারীরাও পেঁপের নল ও গাছের ডাল সরবরাহ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। যেমন শামসুজ্জামান লিটন জানান, একসময় বাগানে পড়ে থাকা পেঁপের ডালই এখন আয় করার সম্পদ।

বিশ্ববাজারে পোষা প্রাণীর খাবার, পোশাক ও খেলনার বাজার বর্তমানে ১৪৩ বিলিয়ন ডলারের এবং তা দ্রুত বাড়ছে। রহমতুল ইসলাম মনে করেন, দেশের তৈরি পোশাক খাতের বাইরে এই পোষা প্রাণীসামগ্রী খাতে মনোযোগ দিলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। এছাড়া, কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা যায় বলেই শতভাগ মূল্য সংযোজন সম্ভব। এ ধরনের উদ্যোগ ছড়িয়ে দিলে গ্রাম পর্যায়ে কর্মসংস্থানও ব্যাপকভাবে বাড়বে।