শিল্পখাতে প্রতিযোগিতায় অগ্রাধিকার না পেয়ে হতাশা: আহসান খান চৌধুরী

প্রতিবেদক: সরকার যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈশ্বিক বাজারে অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করতে চায়, তাহলে শিল্প খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে এই বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি বলে মন্তব্য করেছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী।

চলতি জুন মাসের শুরুতে বাজেট ঘোষণার পর ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর করতে হলে আয়ের উৎস সৃষ্টি করে এমন খাতগুলোকে শক্তিশালী করা জরুরি।” তিনি মনে করেন, রপ্তানিমুখী শিল্প ও হাজারো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্য পূরণে চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়ন এবং আরও তিনটি বন্দরের উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন ছিল।

আহসান খান চৌধুরী বলেন, “বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ৯০ দিনের একটি বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা যেত। কিন্তু বাজেটে তেমন কোনো সাহসী উদ্যোগ দেখা যায়নি।” পোশাক খাতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। তাহলে তিন বছরের মধ্যে দ্বিগুণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ কি অসম্ভব হতো?”

তিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা যেসব মৌলিক সুবিধা দাবি করে আসছেন, যেমন: বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, সেগুলোর দিকেও বাজেটে তেমন মনোযোগ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, “গ্যাস সংযোগের জন্য একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমাকে বারবার অফিসে যেতে হয়, তবুও নির্দিষ্ট নির্দেশনা মেলে না। এতে ব্যবসার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হয়।”

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী। প্রায় ৩৪টি কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত এই গ্রুপের বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার এবং এতে প্রায় দেড় লাখ কর্মী নিয়োজিত আছেন। তারা প্রতিবছর ১৪৫টি দেশে প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে।

আহসান খান চৌধুরী বলেন, “ব্যবসায়ীরা সাধারণত চায়—নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস, নিরাপত্তা, দক্ষ বন্দর, ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের উন্নত যোগাযোগ, উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ভালো লজিস্টিকস ও চাঁদাবাজমুক্ত পরিবেশ। এসব হয়তো বাজেটে লেখা থাকবে না, কিন্তু দিকনির্দেশনায় অন্তত উল্লেখ থাকতে পারত।”

তিনি মনে করেন, এবারের বাজেট আগের মতোই ধারাবাহিক। মানুষ যে সংস্কার, পরিবর্তন ও কর্মসংস্থানের প্রত্যাশা করেছিল, তার প্রতিফলন বাজেটে নেই। বাজেট প্রস্তুতকারীদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “তারা সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করেছেন, তবে এটি ব্যবসায়িক পরিবেশে বড় কোনো পরিবর্তন আনবে বলে মনে করি না।

তিনি করব্যবস্থার বিষয়েও হতাশা প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, বাজেটে নতুন কোনো উদ্যোগ না থাকায় আগের করদাতাদের ওপরই চাপ বাড়বে। ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উচ্চ সুদের হার তাদের অস্তিত্ব ঝুঁকিতে ফেলছে। তাই ক্ষুদ্রঋণ সহজলভ্য করা এবং শিক্ষা খাতে অধিক বিনিয়োগ জরুরি।

“বাংলাদেশের তুলনায় ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অনেক বেশি ব্যয় করে,”—বলেন আহসান খান চৌধুরী। তিনি বিশ্বাস করেন, শুধুমাত্র বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নির্ভর না করে দেশীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে। “১৮ কোটির দেশের অসংখ্য তরুণ উদ্যোক্তা নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়ে থেমে যাচ্ছে,”—বলেই সাহসী উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি।

ফার্নিচারশিল্পের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এই খাত রপ্তানিতে যেতে চাইলেও বন্ড সুবিধার অভাবে পিছিয়ে আছে। রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে এই সুবিধা দিতে হবে।” টার্নওভার ট্যাক্স ১ শতাংশে বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এসএমই খাতের অধিকাংশই ১০ শতাংশ লাভ করে না। এই হার কার্যকরভাবে তাদের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে।”

তিনি বলেন, এই ব্যবস্থা দুর্নীতি বাড়াবে এবং করজালে আসার বদলে ব্যবসায়ীরা এড়িয়ে চলবে। এনবিআরের উদ্দেশে বলি, আগে দেখুন, তারা কত লাভ করে। বিক্রয়ের ওপর এক শতাংশ কর টেকসই নয়।

তাইওয়ানের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “জনসংখ্যায় আমাদের চেয়ে কম হলেও তারা বেশি রপ্তানি করে। এর মানে আমাদের প্রতিভার ঘাটতি নেই। আমাদের তরুণদের সক্ষমতা অসাধারণ।”

বাংলাদেশে ব্যবসা করাটা কঠিন স্বীকার করেই তিনি বলেন, “তবুও দেশ এগোচ্ছে। পারিবারিক সমস্যা থাকলেও, ঋণ চাপ থাকলেও সামনে এগোতে হবে। ইতিবাচক থাকুন, দেশে বিনিয়োগ করুন—দেশও এগিয়ে যাবে।”

সবশেষে তিনি সতর্ক করেন, যদি এই পরিস্থিতি না বদলায়, জনঅসন্তোষ বাড়বে এবং প্রতিবাদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “শিক্ষা, দক্ষতা ও প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দিন। প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া দেশ এগোবে না। সাহসী সংস্কার, ইতিবাচক উদ্যোগ এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সম্ভব।”