
প্রতিবেদক: দেশে বছর বছর বাড়ছে ভুট্টার উৎপাদন। কৃষকেরা বলছেন, ধানের তুলনায় লাভ বেশি, পরিচর্যার খরচ কম এবং বাজার নিশ্চিত—এই তিনটি কারণেই ভুট্টা চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ভুট্টা চাষে ঝুঁকছেন অসংখ্য কৃষক। এর ফলে ধান ও গমের আবাদ কমে ভুট্টা-ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার বিস্তৃতি ঘটছে। এতে একদিকে যেমন পশুখাদ্যের আমদানি নির্ভরতা কমছে, অন্যদিকে ফিডশিল্পের পেছনে গড়ে উঠছে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশে ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। ২০১৫–১৬ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ২৭ লাখ ৫৯ হাজার টন, যা ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ লাখ ৮৪ হাজার টনে।
একই সময়ে ভুট্টার আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০১১–১২ অর্থবছরে যেখানে আবাদ হতো ২ দশমিক ৮৩ লাখ হেক্টরে, সেখানে ২০২৪–২৫ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ লাখ হেক্টরে।
ভুট্টা এখন দেশের ৮০ হাজার কোটি টাকার ফিডশিল্পের মূখ্য উপাদান। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন জানায়, দেশে প্রায় ৩০০ নিবন্ধিত ফিড মিল রয়েছে। ফিড কারখানাগুলো কৃষকের কাছ থেকে ৭০ শতাংশ ভুট্টা নগদে কিনছে এবং বাকিটা আমদানি করছে।
কোয়ালিটি ফিডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহতেশাম বি শাহজাহান বলেন, আমরা এখন শতভাগ ভুট্টা নগদ টাকায় কিনে নিচ্ছি। উৎপাদন যত বাড়ছে, আমদানি তত কমছে।
এনবিআর-এর তথ্য বলছে, ২০২০–২১ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার আমদানি ছিল ২১ লাখ ১৪ হাজার টন। ২০২৩–২৪-এ তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র সাড়ে ৪ লাখ টনে। তবে চলতি অর্থবছরে কিছুটা উৎপাদন ঘাটতির কারণে আমদানি আবার বেড়ে ১৪ লাখ টনে পৌঁছেছে।
দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, চুয়াডাঙ্গা, পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের ১০টি জেলায় ভুট্টা উৎপাদনের বিপ্লব ঘটেছে।
চিরিরবন্দরের কৃষক রশিদুল ইসলাম জানান, তিন বিঘা জমিতে প্রতি বিঘায় গড়ে ৬৫ থেকে ৭৫ মণ ফলন পেয়েছেন, বিক্রি করেছেন প্রতি মণ ৮৭০ টাকায়। এতে বিঘাপ্রতি আয় হয়েছে প্রায় ৬০–৬৫ হাজার টাকা। ধান চাষ করলে আয় হতো ৪০ হাজার টাকার মতো। তাই ধানের জায়গায় এখন ভুট্টা চাষ করছেন অধিকাংশ কৃষক।
চাষের পাশাপাশি ভুট্টা ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন অনেকেই। দিনাজপুরের ব্যবসায়ী আসেফ রহমান জানান, ধানে যেখানে আয় সীমিত, সেখানে ভুট্টা চাষে খরচ কম ও লাভ বেশি। তিনি কৃষকের কাছ থেকে ভুট্টা কিনে ফিড কোম্পানিতে বিক্রি করে ভালো মুনাফা করছেন।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিডব্লিউএমআরআই)-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “কৃষকেরা এখন ভুট্টা চাষকে ব্যবসা হিসেবে দেখছেন। আমদানিকৃত উচ্চফলনশীল জাতগুলো জনপ্রিয় হলেও স্থানীয় জাতেও আমরা কাজ করছি।”
তিনি আরও জানান, ভুট্টা চাষে পানি লাগে কম, বালাইনাশকের প্রয়োজনও তুলনামূলক কম। তাই উত্তরাঞ্চলের পানি সংকটাপন্ন এলাকাগুলোতে ধান বা গমের পরিবর্তে ভুট্টার চাষ বাড়ছে।
ভুট্টা এখন শুধু ফসল নয়, একপ্রকার সম্ভাবনার চাবিকাঠি। কৃষকের আয়ের উৎস, উদ্যোক্তার ব্যবসার ভিত্তি এবং শিল্পকারখানার কাঁচামাল—সব মিলিয়ে ভুট্টা বাংলাদেশের কৃষিতে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। সরকারি সহায়তা ও আধুনিক জাতের সহজলভ্যতা থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ভুট্টায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব।