কাস্টমস অচলাবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, বিপাকে শিল্প ও কৃষি খাত

প্রতিবেদক: দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২০০ কনটেইনার কাঁচামাল আমদানি ও ১৫০–১৭৫ কনটেইনার পণ্য রপ্তানি করে থাকে। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে গত শনিবার থেকে প্রতিষ্ঠানটির এই কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল জানান, কাস্টমস কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সরবরাহব্যবস্থা গুরুতরভাবে ব্যাহত হচ্ছে। কাঁচামাল আমদানি করতে না পারলে উৎপাদন থেমে যাবে, আর উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি না করতে পারলে আর্থিক ক্ষতি আরও বাড়বে। তিনি বলেন, কেবল শনিবারই বন্দরে আটকে পড়া পণ্যের কারণে কোম্পানির ক্ষতিপূরণ (ডেমারেজ) দিতে হয়েছে প্রায় ৮ হাজার ডলার। চলমান অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিনই বাড়বে।

শুধু প্রাণ-আরএফএল নয়, কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের কারণে পণ্য আমদানি-রপ্তানিসহ এনবিআরের সার্বিক কার্যক্রমেই অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। ঢাকার এনবিআর ভবন, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, বেনাপোল, সোনামসজিদ স্থলবন্দর ও দেশের অন্যান্য কাস্টম হাউসে রাজস্ব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে শুল্কায়ন কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।

এ পরিস্থিতির প্রভাব কৃষিপণ্য রপ্তানিতেও পড়েছে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানি বন্ধ থাকায় গত শনিবার প্রায় ১০০ টন শাকসবজি ফেরত নিতে বাধ্য হন রপ্তানিকারকেরা। ফলে কাতারে অনুষ্ঠিত ফল মেলা নির্ধারিত সময়ের আগেই বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ জানান, পণ্য রপ্তানি না হওয়ায় বাজারে এক-তৃতীয়াংশ দামে সেগুলো বিক্রি করতে হচ্ছে, যা সরাসরি ক্ষতি।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান জানান, শুল্কায়নের পর রপ্তানি পণ্য জাহাজে তোলা হয় তিন দিন পর। কাস্টমস বন্ধ থাকায় অনেক জাহাজ নির্ধারিত সময়েই রপ্তানি পণ্য নিতে পারেনি। বিদেশি ক্রেতাদের অনুমতি না মিললে সেই পণ্য বিমানে পাঠাতে হবে বা মূল্যছাড় দিতে হবে, যা ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ায়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ৪ হাজার ৪৯৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.২০% বেশি। মে মাসেই সর্বোচ্চ ৪৭৪ কোটি ডলারের রপ্তানি হয়েছে।

বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, এনবিআরের এই অচলাবস্থা এড়ানো সম্ভব ছিল। সরকার ও আন্দোলনরতদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা হলে বর্তমান সংকট রোধ করা যেত। তিনি জানান, কাস্টমস বন্ধ থাকায় প্রতিদিন ২৫০০-২৬০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য রপ্তানি না হলে অনেক ক্ষেত্রে মূল্যছাড় দিতে হবে বা অর্ডার বাতিল হতে পারে, যা ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য ভয়াবহ।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭ হাজার ২৯২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আমদানি হয়েছে ৫ হাজার ৪৭৯ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের তুলনায় ৪.৬২% বেশি। অপরদিকে, রপ্তানিও এই সময়ে কিছুটা বেড়েছে।

এই অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে তা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও শিল্প খাতের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে—এমন আশঙ্কা করছে ব্যবসায়ী মহল।