
প্রতিবেদক: চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আয় কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ঋণ বিতরণে ঝুঁকি কমাতে অধিকাংশ ব্যাংক এখন নিরাপদ ও উচ্চ সুদদাতা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বেশি করে বিনিয়োগ করছে। এ প্রবণতার ফলে গত বছর ব্যাংকগুলোর এই খাত থেকে আয় বেড়েছে ৪৫ শতাংশ, যার পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোর আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে ৫০টি তফসিলি ব্যাংক ট্রেজারি বন্ড থেকে মোট ৩৯ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকা আয় করেছে। আগের বছর একই খাত থেকে আয় ছিল ২৭ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। সরকারের ট্রেজারি বন্ডকে এখন ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আয় উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে।
২০২৪ সালে সুদ, বিনিয়োগ ও কমিশন থেকে ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত মোট আয় দাঁড়ায় ৭৮ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ট্রেজারি বন্ড ও বিল থেকে এসেছে প্রায় ৫১ শতাংশ অর্থ। এ আয় কাঠামো থেকে স্পষ্ট—ঋণের তুলনায় ব্যাংকগুলো এখন নির্ভর করছে ঝুঁকিমুক্ত উৎসের ওপর।
তবে দেশের ৬২টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ৫০টির তথ্যেই এই বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কারণ বাকি কয়েকটি এখনো ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এ তালিকায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের তথ্যও অন্তর্ভুক্ত নয়।
সুদ আয়ে ব্যাংকগুলোর অবস্থান তুলনামূলক দুর্বল। গত বছর এই খাত থেকে আয় ছিল ২১ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কম। কমিশন ও ফি থেকে আয় বেড়ে হয়েছে ১৬ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগকারীদের অনুপস্থিতি এবং প্রতিষ্ঠানের বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো এখন ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ না দিয়ে ট্রেজারি বন্ডের দিকে ঝুঁকছে। তাঁর মতে, বন্ডে বিনিয়োগে কোনো প্রভিশন রাখতে হয় না, পরিচালন ব্যয়ও কম হয়—ফলে এটি ব্যাংকের জন্য লাভজনক।
এই ধারা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে ব্যালান্স শিটেও। গত বছর ট্রেজারি বন্ডে ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগ ৩২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকায়। এই বন্ড থেকে আয় সবচেয়ে বেশি করেছে সোনালী ব্যাংক—৬ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। এছাড়া ব্র্যাক ব্যাংক আয় করেছে ২ হাজার ৮৮১ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ২ হাজার ৩৩৩ কোটি, পূবালী ব্যাংক ২ হাজার ১৯ কোটি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ১ হাজার ৮০০ কোটির মতো।
সিএফএ সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি আসিফ খান বলেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোর বন্ডে বিনিয়োগ স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক। তিনি মনে করেন, এটি ব্যাংকের মূলধন ভিত্তি মজবুত করতে সাহায্য করবে এবং যারা খেলাপি ঋণে জর্জরিত, তাদের লোকসান পুষিয়ে নিতে পারে।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, আমানতের সুদের হার এবং বন্ডের সুদের হার নিয়ে যে ‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হবে না। ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা গত আড়াই বছরে সর্বোচ্চ। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার কঠোর আর্থিক নীতি শিথিল করতে পারে এবং ট্রেজারি বন্ডের সুদ হার কমতে পারে।
সব মিলিয়ে, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণ থেকে দূরে সরে ব্যাংকগুলো এখন নিশ্চিত মুনাফার উৎস হিসেবে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এতে স্বল্পমেয়াদে আয় বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতে কী প্রভাব পড়ে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।