রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সংকটে বিপর্যস্ত উদ্যোক্তারা

In বন্দর
July 02, 2025

প্রতিবেদক: ২০২৪–২৫ অর্থবছরের শুরুটা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। কোটা সংস্কার আন্দোলন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বছরের শুরুতেই অর্থনীতির চাকা হোঁচট খায়। এরপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং শ্রমিক অসন্তোষ ব্যবসার ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একইসঙ্গে যুক্ত হয় গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকট, উচ্চ সুদের হার এবং মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তা চাহিদা হ্রাসের মতো নতুন সংকট। বছরের শেষ দিকে এসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের আন্দোলনে টানা দুই দিন আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকে, যা আবারও ব্যবসা খাতে অস্থিরতা তৈরি করে।

এই ধারাবাহিক সংকটের মধ্য দিয়েই শেষ হয় ২০২৪–২৫ অর্থবছর এবং গতকাল (১ জুলাই) শুরু হয়েছে নতুন অর্থবছর ২০২৫–২৬। কিন্তু শুরুতেই ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে পুরোনো সমস্যাগুলোর পুনরাবৃত্তি ও নতুন সংকটের শঙ্কায়। উদ্যোক্তারা আশঙ্কা করছেন, দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন কমে যাওয়ায় এবং নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের অনিশ্চয়তায় শিল্পে গ্যাস–সংকট আরও তীব্র হতে পারে। এলএনজি আমদানিও যথেষ্ট হারে না বাড়ালে শিল্প উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারেও চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জুলাই মাসে পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে পারেন, যা বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। প্রতিযোগী দেশগুলো যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষিতে এগিয়ে গেছে, তখন বাংলাদেশ কেবল আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে—এ বিষয়েও হতাশা প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ব্যাংক সুদের হার কমানো। এসবের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা সতর্ক করছেন, যদি নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা বাড়ে, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ আরও খারাপ হয়ে পড়বে।

পরিসংখ্যানও দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা তুলে ধরছে। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৯৭ শতাংশ, যা আগের বছরের ৪.২২ শতাংশের তুলনায় কম। বেসরকারি বিনিয়োগ কমে দাঁড়িয়েছে জিডিপির ২২.৪৮ শতাংশে, যেখানে আগের বছর ছিল ২৩.৫১ শতাংশ। পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও কমে গেছে।

শিল্প খাতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল গ্যাস–সংকট। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে, গ্যাস না থাকায় অনেক কারখানায় উৎপাদন কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁদের ভাষায়, ‘শিল্পবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিল্পকারখানাকে গলা টিপে মারা হচ্ছে’। চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতির মতো বিষয়গুলোকেও সংকটের বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তাঁরা। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাস সরবরাহ কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানিয়েছে বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএ, তবে তারা বলছে, তারা স্থায়ী সমাধান চায়।

অন্যদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আনতে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এতে ঋণের সুদ বেড়েছে এবং ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে রক্ষণশীল হয়ে পড়েছে। যার ফলে ছোট-বড় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নতুন করে আর্থিক সংকটে পড়েছে।

বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ব্যবসার গতি বাড়াতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ‘মব সংস্কৃতি’ বন্ধ করা জরুরি। একই সঙ্গে দ্রুত নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তার অবসান ঘটাতে হবে। না হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবে, যার প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।