সরকারি তথ্যেই সন্দেহ, রপ্তানির হিসাব নিয়ে ফের বিতর্ক

প্রতিবেদক: রপ্তানি পরিসংখ্যানে ‘গরমিল’ এখনো কাটেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যানে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে আসে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পণ্য রপ্তানির হিসাব বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর তৎকালীন সরকার সমালোচনার মুখে পড়ে। এরপর তড়িঘড়ি করে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং প্রায় তিন মাস রপ্তানির পরিসংখ্যান প্রকাশ স্থগিত থাকে।

২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে ইপিবি আবার রপ্তানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। তবে এবারও প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়নি। কারণ, প্রকৃত রপ্তানির সঙ্গে স্থানীয় রপ্তানি ও নমুনা (স্যাম্পল) রপ্তানির হিসাবও একত্রে দেখানো হয়েছে। এতে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বেশি দেখানো হয়েছে। এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকৃত রপ্তানি হয়েছে ৪৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারের। অথচ ইপিবি জানিয়েছে, রপ্তানি হয়েছে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ ইপিবি ১৭১ কোটি ডলার বেশি দেখিয়েছে।

এর আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও একই চিত্র। ইপিবি বলেছে, ওই বছর রপ্তানি হয়েছে ৪৪৪৭ কোটি ডলারের, অথচ এনবিআর বলছে রপ্তানি হয়েছে ৪২৮৬ কোটি ডলারের। এখানেও গরমিল ১৬০ কোটি ডলারের। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নীতিনির্ধারণের ফলে ব্যবসায়িক পরিবেশে নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের নেতৃস্থানীয় সংগঠন বিজিএমইএ-এর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান এ বিষয়ে বলেন, “পরিসংখ্যান সঠিক না থাকলে নীতিনির্ধারণ ভুল হবে। আগের ভুলটি ছিল ইচ্ছাকৃত। এখনো ভুল হচ্ছে কেন, তা দ্রুত খুঁজে বের করে সংশোধন করতে হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের জুলাইয়ে রপ্তানি আয়ের ভিত্তিতে লেনদেনের ভারসাম্যের তথ্য প্রকাশ করলে ইপিবির গরমিল ধরিয়ে পড়ে। তখন দেখা যায়, ইপিবি যেসব হিসাব দিচ্ছে, তার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা আসার মিল নেই। এমনকি সংস্থাটি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মে পর্যন্ত যে হিসাব দেয়, তাতে জুলাই-মে সময়ে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫১৫৪ কোটি ডলার। অথচ পুরো অর্থবছরের শেষে ইপিবি জানায়, রপ্তানি হয়েছে ৪৪৪৭ কোটি ডলারের। অর্থাৎ ১১ মাসেই ৭০৭ কোটি ডলার বেশি দেখানো হয়েছিল।

তিন অর্থবছরের ৩৪ মাসে ইপিবি এনবিআরের তুলনায় ২ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের রপ্তানি বেশি দেখিয়েছে বলে তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাড়িয়ে দেখানো এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিগত সরকার ভুল নীতিমালা নিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) কমিয়ে দেওয়া, ব্যাংকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলতে জটিলতা সৃষ্টি, কিস্তি সময়সীমা কমিয়ে আনা, প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সিদ্ধান্ত।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, “আইএমএফের গাইডলাইন মেনে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের সঙ্গে সমন্বয় করে রপ্তানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করি। স্থানীয় রপ্তানির হিসাব যুক্ত রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছি। ভুল থাকলে সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

বিশ্লেষক ও সিপিডি-এর গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “পরিসংখ্যান অনেকটা ঠিক হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এখনো দুর্বলতা রয়ে গেছে। রপ্তানি ও রপ্তানি আয়ের মধ্যে ফারাক থাকায় সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। ফলে স্থানীয় ও বহির্বিশ্ব—দুই ক্ষেত্রেই নজরদারি জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে, কোন ক্রয়াদেশের বিপরীতে ডলার আসছে না, তা শনাক্ত করাও জরুরি।