
প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্র গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেয়। প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে একটি চিঠি পাঠান, যেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কিছু ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিতও দেওয়া হয়। এরপর বাণিজ্য উপদেষ্টা পর্যায়েও আলোচনা হয়। এমনকি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা দিতে কিছু পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ব্যবস্থাও করা হয়। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র যে অশুল্ক বাধাগুলোর কথা বলেছিল, যেমন—বিনিয়োগের পরিবেশ, মেধাস্বত্ব আইন প্রয়োগ ইত্যাদি—সেসব নিয়েও আলোচনা অব্যাহত রাখা হয়।
তবে তিন মাসের টানা আলোচনা শেষে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে মাত্র ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করেছে। আলোচনার এ ফলাফলকে হতাশাজনক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, এত আলোচনার পরেও বাস্তবিক কোনো উল্লেখযোগ্য সুবিধা আদায় করা সম্ভব হয়নি।
শুল্ক আলোচনার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির খসড়া পাঠালেও, এর বিস্তারিত কিছুই এখনো জানা যায়নি। খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দাবি কী ছিল, তারা বিনিময়ে কী দিতে চেয়েছিল, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমরা কী দাবি করেছিলাম বা কী ছাড় দিতে চেয়েছিলাম—এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়।
শোনা গেছে, বাংলাদেশই প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিল। কিন্তু তিন মাস পর এতটুকু জানা যাচ্ছে যে, মাত্র ২ শতাংশ শুল্ক হ্রাসই এখন পর্যন্ত একমাত্র অর্জন। সরকার জানিয়েছে, চুক্তির খসড়ায় একটি নন-ডিসক্লোজার ক্লজ (তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা) ছিল। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, দর-কষাকষির জন্য অংশীজন ও খাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি টেকনিক্যাল টিম গঠন করলে আলোচনায় আরও ভালো ফল পাওয়া যেত। বাস্তবে দেখা গেছে, অল্প কয়েকজন ব্যক্তিই পুরো প্রক্রিয়ায় কাজ করেছেন, যার ফলাফল খুব একটা সন্তোষজনক হয়নি।
এই অবস্থায় নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের মূল রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে। কারণ, প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, যা বাংলাদেশের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম। এই বিশাল শুল্ক ব্যবধান বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশের পরিবর্তে ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকিয়ে দিতে পারে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, মার্কিন ক্রেতারা এই শুল্কভার সরাসরি রপ্তানিকারকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন।
এই পরিস্থিতিকে অর্থনীতিবিদেরা স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি শুল্ক জটিলতা থাকলে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্রেতারা ধীরে ধীরে বিকল্প উৎসের দিকে চলে যেতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বাংলাদেশের একটি বড় রপ্তানি বাজার, তাই এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য হতে পারে।
আগামী ১ আগস্ট থেকে নতুন ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। এই সময়ের মধ্যে—অর্থাৎ পরবর্তী তিন সপ্তাহে—বাংলাদেশের কী করণীয়, তা এখন দ্রুত নির্ধারণ করতে হবে। তবে বাণিজ্য আলোচনার পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতাও গুরুত্বপূর্ণ, যা অনেকাংশেই গোপন এবং সরকারের কৌশলগত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুল্ক কমানোর জন্য বাংলাদেশকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। যদি শুল্ক হার ভিয়েতনামের সমপর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়, তাহলে কিছুটা হলেও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রাখা যাবে। কিন্তু ৩৫ শতাংশ শুল্ক অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের রপ্তানি কার্যক্রম বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।