
প্রতিবেদক: ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্কনীতি সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে এশিয়ার ছোট দেশগুলোতে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এসব দেশ মার্কিন বাজারে যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে, তার তুলনায় আমদানি করে কম—এই ‘অন্যায্য বাণিজ্য ঘাটতি’ পূরণেই বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। শুল্ক আরোপের আসল লক্ষ্য চীনকে কোণঠাসা করা। তাই যুক্তরাষ্ট্র তাদের শুল্কনীতিতে প্রভাবিত করছে সেই দেশগুলোকে, যারা চীনের ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল অথবা চীনা বিনিয়োগে পরিচালিত।
বাণিজ্য আলোচনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ যেন চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সীমিত করে। ফলে বাংলাদেশ এমন এক অবস্থায় পড়েছে, যেখানে তাকে সবচেয়ে বড় ক্রেতা (যুক্তরাষ্ট্র) ও সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী (চীন)–এর মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হতে পারে।
ওয়াশিংটনের এই চাপের অংশ হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে ব্যাপকভাবে চীনা কাঁচামাল ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীন থেকে ১৬.৬৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা দেশের মোট আমদানির ২৬.৪ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল—যেমন কাপড়, রাসায়নিক এবং আনুষঙ্গিক পণ্য।
যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে কঠোর ‘রুলস অব অরিজিন চাপানোর প্রস্তাব দিয়েছে, যার ফলে মার্কিন বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশি পণ্যে ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজন বাধ্যতামূলক করা হবে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এই প্রস্তাবকে বাংলাদেশের জন্য ‘বড় চ্যালেঞ্জ’ বলে স্বীকার করেছেন।
বিশেষত ওভেন পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি চাপে রয়েছে। কারণ, এ খাতে ব্যবহৃত কাপড়ের ৭০ শতাংশ আমদানি হয় চীন থেকে। বিপরীতে নিটওয়্যার খাত তুলনামূলকভাবে স্বনির্ভর, যেখানে স্থানীয়ভাবে ৯০ শতাংশ সুতা উৎপাদন সম্ভব।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে ৪.৬২ বিলিয়ন ডলারের ওভেন পোশাক আমদানি করেছে, যেখানে নিটওয়্যার খাতের রপ্তানি ছিল ২.৪ বিলিয়ন ডলার।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মূল্য সংযোজন শর্তাবলি এতটাই কঠিন যে বাংলাদেশের পক্ষে তা মানা প্রায় অসম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তাদের শুল্কব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য চাপ দিচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত দেশগুলোর জন্য শুল্ক কম, অন্যদের জন্য বেশি। এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘মোস্ট ফেভার্ড নেশন নীতির সঙ্গে স্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আলোচনায় কিছু ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে। মার্কিন রপ্তানি ঘাটতি কমাতে ঢাকা প্রস্তাব করেছে—মার্কিন এলএনজি, তুলা, সয়াবিন ও বোয়িং বিমান বেশি করে আমদানি করার।
আলোচনায় মার্কিন পক্ষ বিনিয়োগ নিরাপত্তা, চীনা মালিকানার শিল্প খাত প্রসার, মেধাস্বত্ব আইন এবং শ্রম অধিকারের দুর্বলতা নিয়েও উদ্বেগ তুলেছে। মার্কিন বিনিয়োগের পরিবেশ আরও নিরাপদ করার আহ্বানও জানানো হয়েছে।
গার্মেন্টস রপ্তানিকারক ইভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন,চীনা কাপড় দিয়ে তৈরি পণ্যে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের শর্ত বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। এছাড়া তিনি ট্রান্সশিপমেন্ট শুল্ক আরোপের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন—যা ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে আগে যুক্তরাষ্ট্র করেছে।
বর্তমানে ওয়াশিংটনে দ্বিতীয় রাউন্ডের আলোচনা চলছে। তবে বাংলাদেশি পোশাক খাত এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান এই সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের জন্য সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জরুরি সাক্ষাত চেয়েছেন।
বিশ্লেষক মাসরুর রিয়াজ বলেন, এই আলোচনা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ভারসাম্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশ চাইলেও রাতারাতি চীনা নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না।