যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় পিছিয়ে বাংলাদেশ, প্রস্তুতির ঘাটতিই প্রধান কারণ

প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্কহার কমানোর আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করতে বাংলাদেশ দেরি করেছে। দেশের বাণিজ্যবিষয়ক গবেষক, রপ্তানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করতে সরকার সময় নিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনো শুল্ক চুক্তি করতে না পারার প্রধান কারণ হলো সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ব্যবসায়ী ও গবেষকরা মনে করেন, শুল্কহার কমানোর আলোচনায় নেতৃত্ব দেওয়া উচিত ছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের, কিন্তু শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো প্রতিনিধিরা আলোচনাকে যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে পারেননি। পরবর্তীতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আলোচনায় সামিল হন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশসহ ৬০ দেশের জন্য পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি পাঠায়। এরপর কয়েক দিন নিয়মিত বৈঠক হয়ে অবস্থানপত্র প্রস্তুত করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাম্পকে চিঠি পাঠিয়ে তিন মাস সময় চান, যাতে সিদ্ধান্ত স্থগিত থাকে। ৯ এপ্রিল ট্রাম্প প্রশাসন ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক বজায় রেখে সব দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত করে। তবে ৮ জুলাই বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ করার ঘোষণা দেয়, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে। ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করেছে, যেখানে তাদের শুল্ক হার যথাক্রমে ২০ ও ১৯ শতাংশ।

আলোচনার ধারা শুরু হয় ১৬ এপ্রিল, যখন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে বাণিজ্য উপদেষ্টা লুৎফে সিদ্দিকীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর ওয়াশিংটনে আরও আলোচনার সূচি ঠিক করা হয়। ২১ এপ্রিল ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশি কর্মকর্তারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন লুৎফে সিদ্দিকী, কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি। মে মাসে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি এবং লুৎফে সিদ্দিকী আলোচনায় আর থাকেননি। ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘প্রকাশ না করার চুক্তি’ (নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট) হয়। ১৭ জুন অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা প্রথম দফার আনুষ্ঠানিক আলোচনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

এরপর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ২৬ জুন ও ৩ জুলাই ইউএসটিআরের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন (৯-১১ জুলাই)। ৮ জুলাই ট্রাম্পের পক্ষ থেকে শুল্ক হার ৩৭% থেকে ৩৫% করার ঘোষণা আসে।

সরকারি ও ব্যবসায়িক মহল মনে করেন শুল্ক কমানোর আলোচনায় বাংলাদেশ সময় মতো প্রস্তুত হয়নি। হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, “আমাদের কোনো লবিস্ট নেই, অভিজ্ঞতা না থাকা ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, ফলে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি”। বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক অভিযোগ করেন, “ব্যবসায়ীদের আলোচনা থেকে বাদ রাখা হয়েছে, এতে দর-কষাকষিতে স্বচ্ছতা কমেছে”। অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, “এমন বহুপক্ষীয় দল দরকার ছিল যা দর-কষাকষি সমন্বয় করতে পারত”। মালয়েশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী টেঙ্কু জাফরুল আজিজ জানান, যুক্তরাষ্ট্র তাদের কী চায় তা স্পষ্ট জানায়, কিন্তু বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টা প্রকাশ না করার চুক্তির অজুহাতে তথ্য দেন না।

বর্তমানে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প প্রশাসন বিষয়টি আরও এক বছরের জন্য স্থগিত করতে পারে। বাণিজ্য উপদেষ্টা ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা বিভিন্ন আমেরিকান কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন। ব্যবসায়ী ও সরকারি সূত্রের আশা, আগামী কয়েক দিনে আলোচনায় অগ্রগতি হবে।