সাবেক সরকারের সময় বিতরণ করা ঋণ খেলাপিতে, এক বছরে বেড়েছে ৩ লাখ কোটি টাকা

প্রতিবেদক: সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ব্যাংক থেকে বিতরণ করা বিপুল পরিমাণ ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত দলটির শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ঋণ বর্তমানে খারাপ হয়ে গেছে। পাশাপাশি, দেশের অর্থনীতির চলমান মন্দা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন ঋণনীতি—এই দুইয়ের প্রভাবে সামগ্রিকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে দেশের ভালো-খারাপ প্রায় সব ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন মাস শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। যা দেশের বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এর আগে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে এই পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণের হার ছিল ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। ফলে মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা।

এক বছরের তুলনামূলক চিত্রে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সেখানে ২০২৫ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক থেকে যেসব নামে-বেনামে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তার বড় একটি অংশ এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। একদিকে নতুন ঋণ শ্রেণিকরণ নীতিমালা অনুযায়ী কঠোর মানদণ্ড আরোপ, অন্যদিকে ঋণের যথাসময়ে নবায়ন ও আদায় না হওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাফিয়ে বাড়ছে। ব্যাংকের অনিয়ম ও নজরদারির ঘাটতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তী এক দশকে এই পরিমাণ বহু গুণে বেড়ে গেছে। অর্থনীতিবিদরা বারবার অভিযোগ করেছেন, তৎকালীন সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক থেকে বিপুল ঋণ নেন, যার অনেকটাই বিদেশে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করে। ওই সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব ব্যবসায়ীকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তারা অনেকেই এখন তা ফেরত দিচ্ছেন না। সরকারের পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক পুরনো শিথিল নীতি বাতিল করে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে, যার ফলে এসব ঋণ এখন খেলাপির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে।

বিশেষ করে ইসলামি ধারার পাঁচটি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। এসব ব্যাংকের গড় খেলাপি ঋণ ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলো হলো: ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এসব ব্যাংকের একটি বড় অংশ এতদিন চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে সেই নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ায় প্রকৃত আর্থিক চিত্র সামনে আসতে শুরু করেছে।

এ ছাড়া বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক, আইএফআইসি, ইউসিবি, এনআরবি ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং সরকারি খাতের অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। পরিস্থিতি এতটাই সংকটাপন্ন যে, খেলাপি হয়ে পড়া প্রায় ১,২০০ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণ নবায়নের আবেদন করেছে। এর মধ্যে শতাধিক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে বিশেষ বিবেচনায় নবায়নের সুবিধাও পেয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতকে স্থিতিশীল রাখতে এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সহায়তা ও কাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছে।