যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য আলোচনায় অগ্রগতি, সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়তে পারে

প্রতিবেদক: বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনৈতিক শক্তি—যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শীর্ষ অর্থনৈতিক কর্মকর্তারা সোমবার (২৯ জুলাই) সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বৈঠক করেছেন। দীর্ঘদিনের বাণিজ্যবিরোধ নিরসন ও চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে এই উচ্চপর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনার ফল হিসেবে ফের তিন মাসের জন্য যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

স্টকহোমে সুইডিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ‘রোজেনবাদ’-এ অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ও চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী হে লিফেং উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে প্রেসের সামনে কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দিলেও, আলোচনায় মূলত শুল্ক, খনিজ উপকরণ এবং প্রযুক্তি রপ্তানির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ১২ আগস্টের মধ্যে চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি স্থায়ী শুল্কচুক্তি করতে হবে। এর আগে মে ও জুন মাসে অনুষ্ঠিত আলোচনায় উভয় পক্ষ প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছায়, যার ফলে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপ ও দুর্লভ খনিজ রপ্তানি বন্ধের মতো উত্তেজনাকর পদক্ষেপ স্থগিত রাখা সম্ভব হয়েছিল।

১২ মে থেকে দুই দেশ একে অপরের ওপর আরোপিত শুল্ক উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যে আরোপিত শুল্ক ১৪৫% থেকে কমিয়ে ৩০% করে এবং চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে আরোপিত ১২৫% শুল্ক কমিয়ে ১০% করে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার জানিয়েছেন, স্টকহোম আলোচনায় বড় অগ্রগতি না হলেও বিদ্যমান চুক্তির বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ, গুরুত্বপূর্ণ খনিজের সরবরাহ ও ভবিষ্যতের ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্যের ভিত্তি তৈরির চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, অক্টোবরের শেষ বা নভেম্বরের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মধ্যে সম্ভাব্য বৈঠকের প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই যুদ্ধবিরতির সময়সীমা বাড়ানো হতে পারে।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, চীনের সঙ্গে আলোচনার পরিবেশ অনুকূলে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সাময়িকভাবে চীনে প্রযুক্তি রপ্তানিতে কড়াকড়ি শিথিল করেছে।

তবে আলোচনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলছে ভিন্নমতাবলম্বী ও তাইওয়ান ইস্যু। ওয়াশিংটনে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলের সিনেটররা চীনের সংখ্যালঘু, মানবাধিকার ও তাইওয়ান নিয়ে নতুন বিল আনতে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে আগস্টে নির্ধারিত যুক্তরাষ্ট্র সফর স্থগিত করেছেন, যাতে আলোচনার পরিবেশ নষ্ট না হয়।

চীন শুরু থেকেই তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ হিসেবে দেখে এবং যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো ধরনের সমর্থনের কড়া বিরোধিতা করে থাকে। ফলে তাইওয়ান ইস্যু আলোচনার পথে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের বহু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত চীনের দুর্লভ খনিজ ও চুম্বক উপাদান এখন চাপ প্রয়োগের কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, চীন তার রপ্তানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি মডেল থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদাভিত্তিক মডেলে রূপান্তর করুক, যা তাদের দীর্ঘদিনের কৌশলগত লক্ষ্য।

চীনবিষয়ক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক স্কট কেনেডি জানান, মে ও জুন মাসের জেনেভা ও লন্ডনের আলোচনা ছিল মূলত সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রাথমিক উদ্যোগ। এখনো পর্যন্ত গভীর অর্থনৈতিক ইস্যু যেমন—চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি বা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাভিত্তিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ—এসব বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন আলোচনার পথ এখনো জটিল ও সময়সাপেক্ষ হলেও, সাম্প্রতিক বৈঠক যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে এবং ভবিষ্যতের সমঝোতার ভিত্তি স্থাপন করতে সহায়ক হতে পারে। তবে ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন, শুল্কনীতি ও প্রযুক্তি রপ্তানির মতো বিষয়গুলো সমাধান না হলে আলোচনার অগ্রগতি আটকে যাওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।