
প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্কহার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। হোয়াইট হাউস গতকাল শুক্রবার এক ঘোষণায় জানায়, নতুন শুল্কহার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। বাণিজ্য বিশ্লেষক ও উদ্যোক্তারা মনে করছেন, এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য বড় স্বস্তি এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটি একটি কূটনৈতিক সাফল্য।
গত ২৯ জুলাই শুরু হওয়া তিন দিনের আলোচনা শেষে ৩১ জুলাই এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। আলোচনার ঠিক আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে বিশ্বের ৭০টি দেশের ওপর ১০ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এর আগে ২ এপ্রিল বাংলাদেশের ওপর প্রথমে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়, যা পরে জুলাইয়ে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়।
শুল্ক কমাতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু কৌশলগত সুবিধা দিতে হয়েছে। একদিকে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পণ্যে শুল্কহার প্রায় শূন্য করে দিয়েছে। অন্যদিকে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) কনভেনশন মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যার আওতায় শ্রম আইন সংশোধনের কাজও চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই সফল আলোচনার নেতৃত্ব দিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী। খলিলুর রহমান বলেছেন, আলোচনার জটিলতা সত্ত্বেও সময়ের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেই বাংলাদেশ বড় অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান রক্ষায় এ সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের গড় শুল্ক ১৫ শতাংশ। পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ যোগ হওয়ায় মোট শুল্কহার দাঁড়াচ্ছে ৩৫ শতাংশ। এটি ভারতের (২৫%) তুলনায় বেশি হলেও পাকিস্তান (১৯%), ইন্দোনেশিয়া (১৯%), শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের (২০%) সমতুল্য, ফলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে।
এই আলোচনার সফলতায় বড় ভূমিকা রেখেছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সরকারি পর্যায়ে একাধিক নীতিগত সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি খাত যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে চুক্তি করে প্রায় ২৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সয়াবিনবীজ ও তুলা আমদানির সমঝোতা করেছে। এর মধ্যে মেঘনা গ্রুপ তিন লাখ টন সয়াবিনবীজ (১৩ কোটি ডলার), ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ১০ কোটি ডলার এবং সালমা গ্রুপ, এশিয়া কম্পোজিট ও মোশাররফ গ্রুপ মিলিয়ে প্রায় চার কোটি ডলারের তুলা আমদানির সমঝোতা করেছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঁচ বছরে সাত লাখ টন করে গম আমদানির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যার প্রথম ধাপে ২ লাখ ২০ হাজার টনের প্রস্তাব ইতিমধ্যে অনুমোদন পেয়েছে। এলএনজি আমদানিও বাড়ানো হবে বলে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। একইসঙ্গে বোয়িং কোম্পানি থেকে আরও ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোর কারণেই ২০ শতাংশ শুল্কহার অর্জন সম্ভব হয়েছে। শ্রম অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন এবং আইন সংশোধন নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, এ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ বড় একটি অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা পেয়েছে। শুল্কহার কমে প্রধান প্রতিযোগী দেশগুলোর সমান কিংবা কিছুটা কম থাকায় বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা এখন আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকবে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরাও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, এটি রপ্তানি খাতের জন্য একটি স্বাগতযোগ্য পদক্ষেপ। তবে এখন আত্মতুষ্টির জায়গা নেই। বরং এটি সতর্কবার্তা—বাংলাদেশকে এখনই বহুমুখী, প্রতিযোগিতামূলক ও সহনশীল বাণিজ্যকৌশল গড়ে তুলতে হবে।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির বলেছেন, বিশ্বশক্তির চাপের মধ্যে থেকে এই সাফল্য সরকারের পরিপক্বতা ও দক্ষতারই প্রমাণ। তিনি এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আলোচক দলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান।