
প্রতিবেদক: স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি তুলেছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, এখনই এলডিসি থেকে বের হলে রপ্তানি খাতসহ অর্থনীতির নানা খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সম্প্রতি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা এক সেমিনারে এ দাবি জানান, যার পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। তবে সরকার বলছে, নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ২০২৬ সালেই এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে।
জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ এলডিসি তালিকা থেকে বের হবে। অর্থাৎ হাতে আছে প্রায় ১৫ মাস। অথচ এই সময়ে এসে উত্তরণ পেছানোর দাবি উঠেছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) আনিসুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ সত্ত্বেও নির্ধারিত সময়েই বাংলাদেশ উত্তরণ ঘটাবে। তাঁর মতে, সময় পেছালেই বিদ্যুৎ সংকট বা যানজটের মতো সমস্যার সমাধান হবে না; বরং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যেই মোকাবিলা করতে হবে।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, উত্তরণের সময় পেছাতে হলে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে। আট বছর সময় পাওয়ার পরও প্রস্তুত নয়—এমন অজুহাত যথেষ্ট নয়। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের উচিত এখন মসৃণ উত্তরণ কৌশল (এসটিএস) বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়া। এ জন্য শিল্প উৎপাদন, ওষুধ ও কৃষিখাতে উদ্যোক্তাদের যুক্ত করা জরুরি। তিনি আরও তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন: অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা, শ্রম ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা।
এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার দুটি উপায় আছে—প্রথমত, সরকারপ্রধান সরাসরি জাতিসংঘের ইকোসকের সিডিপির কাছে যৌক্তিক কারণ উল্লেখ করে আবেদন করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ সরাসরি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আবেদন করতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে শক্তিশালী দেশগুলোর সমর্থনও প্রয়োজন হবে। অতীতে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ গৃহযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ দেখিয়ে সময় বাড়িয়েছে। অ্যাঙ্গোলা তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে সময় বাড়িয়েছে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে সামরিক ক্যুর কারণে সিডিপি নিজেই উত্তরণ পিছিয়ে দেয়। একইভাবে সুনামির কারণে মালদ্বীপ ও ভূমিকম্পের কারণে নেপালের উত্তরণ বিলম্বিত হয়।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনই উত্তরণ হলে পোশাক ও ওষুধ খাতসহ রপ্তানিতে বড় প্রভাব পড়বে। এলডিসি সুবিধা না থাকলে শুল্ক বাড়বে ১২ শতাংশ পর্যন্ত, যা রপ্তানি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে। তাঁদের মতে, ভালো বাণিজ্য দরকষাকষি, রপ্তানি বৈচিত্র্য, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং জলবায়ু সহনশীলতা তৈরির জন্য আরও ৩ থেকে ৬ বছর সময় প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ২০১৮ সালে এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। সাধারণত এই প্রক্রিয়া ছয় বছরে শেষ হয়, তবে কোভিডের কারণে আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয় এবং চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। উল্লেখযোগ্য হলো, এখন পর্যন্ত ভুটান, বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ, সামোয়া, ভানুয়াতু এবং সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ—এই আটটি দেশ এলডিসি তালিকা থেকে বের হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ, লাওস ও নেপালসহ আরও কয়েকটি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের অপেক্ষায় রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার দাবি তুললেও সরকার বলছে নির্ধারিত সময়েই উত্তরণ ঘটবে। তবে সময় পেছাতে চাইলে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে যৌক্তিকতা প্রমাণের কঠিন চ্যালেঞ্জ।