ভ্যাট আইনে ‘ল্যাংড়া-খোঁড়া’ অবস্থা, স্বীকারোক্তি এনবিআর প্রধানের

প্রতিবেদক: ব্যবসায়ীদের বাধার কারণে ভ্যাট আইন প্রণয়নে দেরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান। তিনি জানান, ভ্যাট আইন নিয়ে ২০১২ সাল থেকে সাত বছর ধরে ঝগড়া-বিবাদ চলেছে। তবুও শেষ পর্যন্ত একটি “ল্যাংড়া-খোঁড়া” আইন হয়েছে। যে ধরনের কার্যকর আইন হওয়া দরকার ছিল, তা করা সম্ভব হয়নি।

মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এনবিআর নিয়ে অনেক ডকুমেন্ট করা হয়, কিন্তু তা কাজে লাগানো হয় না। এবার থেকে কোনো ফাইন্ডিং আর সেলফে ফেলে রাখা হবে না, বরং কাজে লাগানো হবে।

ব্যবসায়ী মহলে ভ্যাটের জটিল হার নিয়ে সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবে দ্বন্দ্ব রয়েছে। টেক্সটাইল মালিকরা অভিযোগ করেন, আমদানিকারকদের ওপর ট্যাক্স চাপিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে বিকেএমইএর ভোক্তারা উল্টো কথা বলেন। তাদের দাবি, ভারত থেকে ল্যান্ড পোর্ট দিয়ে আমদানি করতে গিয়ে লিডটাইম বেড়ে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এসব ভিন্ন অবস্থান বিবেচনা করে দেশের স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তিনি আরও বলেন, আয়কর দিতে হবে আয়ের ওপর আর ব্যবসার টার্নওভারের ওপর দিতে হবে ভ্যাট—এটা কঠিন কিছু নয়।

সংলাপে সাবেক অর্থ সচিব সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্যক্তির অনলাইন রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হলেও কর্পোরেট খাতে দ্রুত তা বাস্তবায়ন জরুরি। শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবসা আলাদা করে কর আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। তিনি প্রস্তাব করেন, করপোরেট ট্যাক্স কাঠামো এমনভাবে সংস্কার করা দরকার যাতে রপ্তানিমুখী ও অরপ্তানিমুখী উভয় খাতের জন্য করহার ১৫ শতাংশের নিচে না হয়।

ট্যাক্স বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ এইচ মাহবুব সালেকিন বলেন, কর অফিসে দুর্নীতি তুলনামূলকভাবে বেশি। মামলাগুলো দ্রুত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সমাধান করা গেলে রাজস্ব আহরণ বাড়ত এবং বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমত। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এনবিআর চেয়ারম্যান এ বিষয়ে আন্তরিক ভূমিকা রাখবেন।

ভ্যাট বিভাগের প্রথম সচিব মশিউর রহমান বলেন, আগামী ১০ বছরের রাজস্ব কৌশলপত্র ঘোষণা করা হয়েছে। ভ্যাটের আওতা বাড়ানো গেলে দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফল পাওয়া যাবে। তখন ভ্যাট রেট নিয়ে অভিযোগও কমে আসবে। তবে এখনই ভ্যাট রেট কমালে রাজস্ব আহরণে বড় প্রভাব পড়বে।

অনুষ্ঠানে সিপিডির এক সমীক্ষা তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, ব্যবসায়ীদের ৭৯ শতাংশ কর কর্মকর্তার জবাবদিহির অভাবকে বড় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ৭২ শতাংশ বলেছেন, কর প্রশাসনে দুর্নীতি তাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে, সম্পূর্ণ ডিজিটাল কর জমা দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকা ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

ভ্যাট সংক্রান্ত আরেক সমীক্ষায় ব্যবসায়ীরা বহুমাত্রিক ভ্যাট হারের জটিলতাকে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অংশগ্রহণকারী ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, জটিল ভ্যাট আইন তাদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া অস্পষ্ট নীতিমালা, কর কর্মকর্তাদের সীমিত সহযোগিতা, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার অভাব, পণ্য ও সেবার শ্রেণিবিন্যাসে জটিলতা এবং উচ্চ অনুবর্তন ব্যয় ব্যবসায়ীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এন্টারপ্রাইজ সার্ভের কাঠামো অনুসারে পরিচালিত এই ভ্যাট সমীক্ষায় ঢাকা ও আশপাশের জেলাসহ মোট ৩৮৯টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১২৩টি প্রতিষ্ঠানের ওপর আলাদা জরিপ চালানো হয়। সমীক্ষা মতে, ৬৫ শতাংশ ব্যবসায়ী নিয়মিত কর দাবিকে কেন্দ্র করে কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। তাদের অভিযোগ, কর কর্মকর্তারা অনেক সময় যথাযথ ব্যাখ্যা ছাড়াই ইচ্ছেমতো কর আরোপ করেন, যা ব্যবসার জন্য অদৃশ্য চাপ তৈরি করে এবং বেশি ক্ষতির কারণ হয়।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র গবেষক মো. তামিম আহমেদ।