তাঁত থেকে কাঠশিল্পে ভাগ্যবদল যশোরের তেঘরিয়া এখন কুটিরশিল্পের গ্রাম

প্রতিবেদক: যশোর সদরের তেঘরিয়া গ্রামের একরামুল হোসেন ৩৪ বছর ধরে তাঁতের গামছা বুনতেন। এই পেশায় আয় কমে যাওয়ায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। ৫২ বছর বয়সে তিনি পেশা বদলে কাঠের খুন্তি, চামচ, লেবু চাপা ও ডালঘুঁটনি তৈরিতে মনোযোগ দেন। বর্তমানে তিনি নিজস্ব কারখানা গড়েছেন, যেখানে নারী-পুরুষ মিলে কাজ করছেন ১৫ জন।

একরামুলের পথ ধরে তেঘরিয়ায় আরও অন্তত ২৬ জন উদ্যোক্তা বিভিন্ন কুটিরশিল্প কারখানা গড়ে তুলেছেন। এসব কারখানায় কাঠের খুন্তি, চামচ, ডালঘুঁটনি, লেবুচাপা, চিরুনি ইত্যাদি তৈরি হয়। বর্তমানে গ্রামজুড়ে এই শিল্পে প্রায় ৫০০ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বছরে এখান থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকার পণ্য সারা দেশে বিক্রি হয়।

সম্প্রতি তাঁর কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, চারটি যন্ত্রে কাঠের চামচ ও খুন্তি বানানো হচ্ছে। একরামুল বলেন,১৯৮৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গামছা–লুঙ্গি বুনেছি। শেষে যা আয় হতো, তাতে সংসার চলত না। গ্রামেই সুবোধ রায়ের কারখানায় কাজ শিখে নিজস্ব কারখানা দিই। আমার এক ভাতিজা তৈরি পণ্যের ছবি ইন্টারনেটে দিলে বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার আসতে শুরু করে।’

প্রথমে এক লাখ টাকা বিনিয়োগে একটি মেশিন কেনেন। এখন তাঁর কারখানায় আটটি যন্ত্র আছে, যেখানে আটজন কাজ করেন। গ্রামের নারীরা পণ্য পলিশের কাজ করেন।

২০১২ সালে কাঠের আসবাব নির্মাতা সুবোধ রায় প্রথম এই গ্রামে কাঠশিল্প কারখানা গড়েন। পরে তাঁর কাছ থেকে শিখে কমপক্ষে ৫০ জন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন বা কমিশনে অন্য কারখানায় কাজ করছেন।

সুবোধ রায় বলেন,বয়স বাড়ছিল, ভেবেছিলাম নিজে কারখানা করলে বাড়ি থেকেই দেখভাল করা যাবে, আর গ্রামে কর্মসংস্থানও হবে। এখন বছরে ৩০ থেকে ৩২ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করি, তবে বিদ্যুৎ না থাকায় চাহিদা মতো উৎপাদন করতে পারি না। বিদ্যুৎ ঠিক থাকলে বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি বিক্রি হতো।’

সুবোধ রায়ের কারখানায় কাঠ কাটার জন্য আলাদা অংশ এবং নকশা করার জন্য আছে আরেকটি অংশ। তৈরি পণ্য বান্ডিল করে গ্রামের নারীরা বাড়িতে নিয়ে পলিশ করেন। এই কারখানায় মাসে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন প্রদীপ ভাস্করসহ অনেক শ্রমিক।

তেঘরিয়া গ্রামের সবচেয়ে বড় কারখানা এখন দিলীপ কুমার দাশের। সেখানে ৩৫–৪০ জন কাজ করেন এবং বছরে বিক্রি হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকার পণ্য। এ ছাড়াও রমেশ রায়, অমল রায়, মণি গোপাল ও সুজন রায়ের মতো উদ্যোক্তারা নিজ নিজ কারখানা গড়ে তুলেছেন।

ঢাকার বাড্ডা এলাকার পাইকারি ব্যবসায়ী তুহিন পারভেজ বলেন,যশোরের মতো মানসম্মত কাঠের পণ্য তৈরির জায়গা আর পাইনি। সুবোধ রায়ের কারখানা থেকে মাসে দুই লাখ টাকার পণ্য কিনি।’

আরেক পাইকারি ব্যবসায়ী মো. আবদুল্লাহ বলেন,যশোর থেকে পণ্য কিনে নরসিংদী, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলায় পাঠাই।’

এই কুটিরশিল্পে মূলত ব্যবহৃত হয় মেহগনি কাঠ, পাশাপাশি নিম ও শিশু কাঠও মান বাড়াতে ব্যবহার হয়। উদ্যোক্তাদের বড় সমস্যা হলো মূলধন ও বিদ্যুতের ঘাটতি। এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়, ফলে সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হয়।

বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক এনাম আহমেদ বলেন,একই গ্রামে ২৬টি কারখানা আছে, বিষয়টি জানা ছিল না। দ্রুত পরিদর্শন করে তাদের কুটিরশিল্প সুবিধার আওতায় আনব। সহজ শর্তে স্বল্পসুদে ঋণ এবং বিদ্যুতের বিষয়ে সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।